কৃষিসংবাদ

আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত বিলম্বে হলেও অভিনন্দনযোগ্য

আড়াই লাখ টন ধান

নিতাই চন্দ্র রায়
আড়াই লাখ টন ধান ঃ চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি ২৬ টাকা দামে আরও আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিলম্বে হলেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবিদার ও অভিনন্দন যোগ্য। অপরদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিডিপি) বলছে , ধানের দাম কমায় কৃষক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষকের এই ক্ষতি পূরণের জন্য প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে নগত সহায়তা প্রদান করা উচিত। এতে সরকারের ব্যয় হবে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষকের ব্যাংক হিসাবে টাকাটা সহজে পৌঁছে দেয়ারও সুযোগ রয়েছে। রপ্তানি খাতে ঢালাওভাবে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দাবি করা হচ্ছে। এতে লাগবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ফলে কৃষকের ৯ হাজার ৪০০কোটি টাকা ভর্তুকি বেশি নয়। এটা দিলে তা হবে যুক্তিযুক্ত ও সাম্যবাদী আচরণ ।

দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে দিতে ২৬ টাকা কেজি দরে আরও আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর আগে একই দামে কৃষকের কাছ থেকে চলতি বোরো মৌসুমে দেড়লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি চার লাখ টন ধান কিনবে সরকারের খাদ্য বিভাগ।গত ১১ জুন, সচিবালয়ে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এসময় কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকসহ দুই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন । সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এবার বোরো ফলন ‘অনেক উদ্বৃত্ত’ হয়ে গেছে। দেশের খাদ্য গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা ১৯ লাখ ৬০ হাজার টন। আর এখন গুদামে আছে ১৪ লাখ টন খাদ্য শস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক কৃষকের কাছ থেকে আরও আড়াই লাখ মেট্রিক টন ধান কেনা হবে। এতেও বাজার না উঠলে, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পান । এই আড়াই লাখ টনের বাইরে প্রয়োজনে আরও এক বা দুই লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে কেনা হবে বলে জানান, কৃষি মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে চলতি বোরো মৌসুমে মোট ১৩ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত এই সংগ্রহ অভিযান চলবে। এর মধ্যে প্রতিকেজি ২৬ টাকা দরে কৃষকের কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান, প্রতি কেজি ৩৫ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল এবং প্রতিকেজি ৩৬ টাকা দরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের নিকট থেকে সংগ্রহ করা হবে। এতে কৃষকের চেয়ে মিল মানিক ও চাল ব্যবসায়ীরাই বেশি লাভবান হবেন । তাঁরা কৃষকের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে ধান কিনে চাল তৈরি করে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দরে সরকারি গুদামে সংগ্রহ করবেন।অন্যদিকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক ধান উৎপাদন করেন, তাঁকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হতে হবে।
সময় মতো সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু না হওয়ায় এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী, মিল মালিক ও ফড়িয়া সেই সুয়োগ গ্রহণ করে ইচ্ছে মতো ধানের দাম নির্ধারণ করায় ধান নিয়ে মহা বিপদে পড়েন কৃষক। ধানের দাম একেবারে কমে যায়। দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হয় ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে। অন্যদিকে ধান কাটার জন্য প্রতিদিন কৃষি শ্রমিকের মজুরি দিতে হয় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এতে কৃষকের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কৃষক সংগঠনগুলি দেশের নানা জায়গায় রাস্তায় ধান ফেলে প্রতিবাদ জানায়। মানববন্ধন ও বিক্ষেভ মিছিল করে। জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারক লিপি প্রদান করে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সরকার নির্ধারিত দামে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়, কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ এবং বিনামূল্যে কৃষকের মধ্যে সার, বীজ ও কীটনাশক বিতরণের দাবি জানায়।দাবি জানায় কৃষি খাতে ভর্তুকি ও বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য।১৪ দলীয় জোটের শরীকেরাও এব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষককে বাঁচাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মন্ত্রণালয়কে বেশি ধান কেনার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। পাশাপাশি চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয় এবং ধানের দাম বৃদ্ধির জন্য চাল আমদানি নিষিদ্ধ করতেও নির্দেশ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
জানা যায়, ধান চালের আর্দ্রতা মাপার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় তিন হাজার মেশিন ক্রয় করবে, যাতে কৃষক সরকারি গুদামে ধান সরবরাহের আগে তাঁর ধানের আর্দ্রতা ঠিক আছে কিনা, তা জেনে নিতে পারেন। ভবিষ্যতে কৃষকের কাছ থেকে অধিক পরিমাণ ধান সংগ্রহর জন্য সরকার দেশের ২০০ স্থানে পাঁচ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টিলের মিনি পেডি সাইলো নির্মাণ করবে। সেখানে কৃষকের ধান শুকানোর জন্য ড্রায়ার মেশিনেরও ব্যবস্থা থাকবে। এ সব কার্যক্রম কৃষকের কাছে থেকে সরাসরি ধান কেনার কর্মকা-কে ত্বরান্বিত করবে এবং কৃষকের ভোগান্তিও কিছুটা হলেও লাঘব হবে।
অন্যদিকে সরকার কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ১০ থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল রপ্তানির বিষয়টিও সক্রীয়ভাবে বিবেচনা করছে। এব্যাপারে খাদ্যনীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের( ইফপ্রি) মতে, বাংলাদেশ এখনো চাল রপ্তানির পর্যায়ে পৌঁছেনি। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে ভারতের পশ্চিবঙ্গের মতো পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ধান চালের দাম, কৃষি ব্যবস্থাপনা ও চালের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, ধানে দামের ওঠানামায় গরিব ক্রেতা ও কৃষক বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সরকারে এই মুহুর্তের কর্তব্য হবে – এ দুই শ্রেণির মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। বাংলাদেশে ধান-চালের উৎপাদন এখনো স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়নি। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হয়। আবার কোনো বছর কম হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতারা এ ধরনের অস্থিতিশীল উৎপাদনের দেশ থেকে চাল কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করবে না। এছাড়া দেশে রপ্তনিযোগ্য কী পরিমাণ চাল আছে , তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রমাণ নেই। অপরদিকে উৎপাদিত চালের বাজারও খুবই সীমিত।আর এই চালের বাজার ভারত নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাংলাদেশ চাইলেও দেশটির পক্ষে চাল রপ্তানি করা খুব সহজ হবেনা।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে তার দাম মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কৃষকের ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়ে দেয়। গ্রাম এলাকা থেকে কৃষকের ধান সংগ্রহের জন্য আছে ‘সেলফ হেলপ গ্রুপ’ নামের দল। তারা কৃষকের ধান সংগ্রহ করে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে জানায়। আর রাজ্য সরকার ওই ধান বাংলাদেশী টাকায় ২০ টাকা ৮০ পয়সা কেজি দরে সংগ্রহ করে।রাজ্য সরকার এ বছর সরাসরি কৃষকের কাছে থেকে ৫২ লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে। বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিবঙ্গ সরকার কৃষকদের ভর্তুকি ও সহায়তা দেয় বেশি। সরকার বেসরকারি গুদাম ভাড়া দিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় ধান সংগ্রহ করে রাখে। পরে তারা বেসরকারি মিল মালিকদের কাছ থেকে ওই ধান ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করে। যে সব ‘সেলফ হেলপ গ্রুপ ’ কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে এনে দেয় তাদের প্রতিকুইন্টাল ধানের জন্য ৩১.২৫ রুপি করে দেওয়া হয়। গুদামে বয়ে আনার জন্য পরিবহন খরচ হিসেবে অতিরিক্ত ২০ রুপি করে প্রতি কুইন্টালের জন্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারে উচিত হবে বছরের শুরুতে ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে তা কৃষককে জানিয়ে দেওয়া। এতে কৃষক কী পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রীর কথা- সামনের বছর থেকে যত দ্রুত সম্ভব ধানের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করা হবে। ধান সংগ্রহের পরিমাণ পর্যাক্রমে বৃদ্ধি করে ৫০ লাখ টনে উন্নীত করা হবে।
আমাদের কথা হলোÑ পশ্চিবঙ্গের রাজ্য সরকার যদি বছরে ৫২ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সংগ্রহ করতে পারে, তা হলে বাংলাদেশ পারবেনা কেন? বাংলাদেশও পারবে। এজন্য প্রয়োজন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ ও মূল্য প্রদানের একটি যুগপোযোগী কৃষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সারের ওপর থেকে ভতুর্কি তুলে দেয়ার ফলে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, উৎপাদিত ফসলের সবটুকু বিক্রি করেও কৃষক সারের দামটাই তুলতে পারতেন না।অন্য খরচের কথাতো ভাবাই যেত না। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষক হাজার হাজার একর জমিতে কোনো ফসলের চাষ না করে পতিত ফেলে রেখে দেন। পরবর্তীতে দেশে খাদ্যশস্যের চরম অভাব দেখা দেয়। খাদ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। সরকার বেশি দাম দিয়েও বিদেশ থেকে সময় মতো চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। ধান চাষ করে প্রতিবছরই কৃষককে যদি লোকসান গুনতে হয়, তাহলে একটা সময় আসবে, যখন কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে জমি পতিত ফেলে রাখবেন। তখন কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেও বিদেশ থেকে সিদ্ধ চাল আমদানি করে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এজন্য যে যাই বলুক, খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং স্বল্প সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থাসহ বাজেটের কৃষি খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বৃদ্ধির ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখকঃ সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
গোপালপুর , নাটোর

Exit mobile version