কৃষিসংবাদ

বাংলাদেশে চালের দাম হঠাৎ বৃদ্ধি ও এর দায়বদ্ধতাঃ একটি পর্যালোচনা

মোঃ বশিরুল ইসলাম

যেই সময়ে ধান ওঠে, সেই সময়ে মিল মালিক বা বড় বড় ব্যবসায়ীরা মজুদ করে। যখন কৃষকের কাছে ধান থাকে না, তখন তারা বেশি মূল্যে ধান বাজারজাত করে। কৃষকরা যখন ধান বিক্রি করে তখন দাম থাকে না। আর এখন চাল কিনতে গেলে চালের দাম বেশি। মোটা চালের দাম এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এক কেজি চাল কিনতে হচ্ছে ৫২ টাকায়। শুধু মোটা চাল নয় সব ধরনের চালের দামই বিগত বছরের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ায় কষ্টের মধ্যে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষসহ স্বল্প আযের পরিবারগুলো। এভাবে চলতে থাকলে এদেশে অচিরে ভঙ্কর দূর্ভিক্ষের সৃষ্টির হবে আর এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের মালিক হয়ে যাবে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই মুহূর্ত থেকে মনিটরিং প্রয়োজন।

আমরা দেখেছি হাওর অঞ্চলে বন্যা এবং ১৯ জেলায় ধানক্ষেতে ব্লাস্টের কারণে এ বছর ২০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। আর এই ঘাটতি মেটাতে সরকার গত জুলাইয়ে ভিয়েতনাম থেকে ২ লাখ টন চাল আমদানি করে। বর্তমানে সাড়ে চার লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে। এরপরও দেশে বর্তমানে এক কোটি টন চালের মজুত আছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। তবে সারা দেশের কল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারকে জানিয়েছে, তাদের কাছে সর্বসাকুল্যে প্রায় ৬ হাজার টন ধান ও সাড়ে ৫ হাজার টন চাল আছে।

নয় মাসে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। অন্যদিকে অনেক দেশে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারেও প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ার কারণ কী? দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ৩৯৬ লক্ষ ৯০ হাজার টন। পূর্ববর্তী বছরে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯০ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছিল ৬ লক্ষ মেট্রিক টন। বর্তমান অর্থবছরেও খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন। তথ্যে কোনো সমস্যা নেই। তাহলে বাজারে এমন গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য নিয়ে কারা ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে? যখনই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা হয় তখন সরকার ‘ট্রাক সেল’, ওপেন মার্কেট অপারেশন করে বাজারকে স্থিতিশীল করে। এটা শুধু চালের ক্ষেত্রে সত্যি নয়, প্রায় সকল ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি। এতে কাজ হয়। ব্যবসায়ীদের ধমক দেখিয়ে কোনো লাভ কোনো দিন হয়নি। বরং এ নিয়ন্ত্রনে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যেক উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্র ক্ষমতা দিয়ে এ নিয়ন্ত্রন অনেক অংশে সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। নতুবা এ সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। আজ চালে দাম বৃদ্ধি করেছে অন্যদিন আদা, রসুন, পেঁয়াজ, ডাল প্রভূতি মজুত করে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে এসব মূল্য বৃদ্ধি করবেই।

বর্তমান সরকারে নির্দেশে চাল আমদানির শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে চালের ওপর থেকে শুল্ক কমছে শতকরা ১৮ টাকা। এতে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম কমার কথা কমপক্ষে ৬ টাকা। আর আমরা দেখছি- বর্তমানে চালের বাজার বলতে গেলে বেসামাল হয়ে পড়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও চালের বাজার আবার অস্থির হয়ে উঠেছে কেন সে এক বিরাট প্রশ্ন। দেশে শুধু বেসরকারি পর্যায়ে যে চাল আমদানি হয়েছে, তাতে কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। দেশে যথেষ্ট চাল আছে, কিন্তু সেই চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মজুদ রেখেছে। সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় চালের বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে। চালের বাজারে এই অস্থিরতার পেছনে আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিলারদের হাত রয়েছে। এটা মূলত অসৎ ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তারা প্রতিবছরই নানা অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এমনকি ব্যবসায়ি একটা মহল বাজারে চালের মূল্য অস্থিতিশীল করতে নানাধরনে অপপ্রচার চালিয়ে যায়। আমরা দেখেছি মহলটি গত ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের মিনিস্ট্রি অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র স্বাক্ষরবিহীন একটি ভুয়া চিঠি বেনাপোল এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাঝে প্রচার করেছে। চিঠিতে বলা হয়, ১৫ সেপ্টেম্বরের পর ভারত বাংলাদেশে চাল রপ্তানি করবে না। চিঠির সূত্র ধরে আমদানিকারকরা ইচ্ছেমত চালের মূল্য কেজি প্রতি ৮ থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্বাধীনতার পর ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং চিকন চাল ৫৬ টাকায় উঠেছিল। সেই থেকে বাড়তে থাকা চালের দাম আজও স্থিতিশীল হয়নি। পরিস্থিতিটা ২০০৮ সালের মত কীনা তা বোঝা যাচ্ছে না। ঐ সময়ে টাকা দিয়েও আন্তর্জাতিক বাজারে চাল মিলেনি। আমি দেখেছি, সে সময় মানুষকে আলু খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল -বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান। আমার মনে আছে গানও বানানো হয়েছিল।

মনে রাখতে হবে, খাদ্য নিরাপত্তার কারিগর বা পাহারাদার হচ্ছে কৃষক। কৃষকগণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে আমাদের জন্য ফসল উৎপাদন করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বিগত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে সমৃদ্ধির ধারা সূচিত হয়েছে তা রোদে পোড়া কৃষকের কল্যাণে। বর্তমান সরকারও কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। সার, বীজ, কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হলেও কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সরকার অনেকটাই ব্যর্থ। কারণ অনেক সময় ধান, চাল, গম কখনো আলুর ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। এ বঞ্চনার শেষ কোথায় তারা জানে না।

ভাত এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। এর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। কাজেই জনস্বার্থেই এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। কারণ একদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে মিল মালিক ও মজুদদারদের খামখেয়ালিপণার কারণে জনগণকেও বেশি দাম দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চাই। সরকারের কার্যকর উদ্যোগই পারে এর সমাধান দিতে।

এছাড়া, কম শুল্কে আমদানি করা চাল কোথায়, কতো দামে বিক্রি হচ্ছে তা কে মনিটর করবে? শুল্ক কমানোর ফলে চালের বাজারে যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা, তা কি পড়েছে? যদি না পড়ে তাহলে এর জন্য কে দায়ী? দায়ীদের শনাক্ত করা হবে কি, তারা শাস্তি পাবে কি? এসব সহজ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া নিয়েই জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা দেখছি- শুল্ক কমানো ফলে এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এই মুহূর্ত থেকে মনিটরিং প্রয়োজন।

সরকারী ব্যবস্থাপনায় চালের দাম ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা কেন হলো, এটাও এখন আমরা জানি। এটা যে ওএমেসের দাম বৃদ্ধির কারণেই হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই সবাই অবগত। আমরা দেখছি- চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। আমরাও আশা করছি খুব শীঘ্রই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। আর বাজার মনিটিরিং জন্য সরকার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রি ক্ষমতা দিয়ে এ পরিস্থিত নিয়ন্ত্রনে কাজ করতে পারে।

লেখকঃ
জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল-mbashirpro1986@gmail.com

Exit mobile version