কৃষিসংবাদ

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠালঃ বহু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি অনন্য ফল

শাহীন সরদারঃ

আদিকাল থেকেই ফল প্রতিটি মানুষের সুখাদ্য হিসেব সমাদৃত হয়ে আসছে। ফলের মধ্যে নিহিত রয়েছে আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হল ফল। আর এ ভিটামিন ও খানিজ আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

বাড়িয়ে শরীর ও মনকে রাখে সবল, সতেজ ও সুস্থ। ফলে আমরা হয়ে উঠতে পারি সুস্থাস্থ্যের অধিকারী ও কর্মঠ। বাংলাদেশে বর্তমানে ২.৬৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে ফলের চাষ করা হয়। ফলের মধ্যে কাঁঠাল পৃথিবীর বৃহত্তম ফল এবং এটি আমাদের জাতীয় ফল। আমাদের দেশে আবাদের দিক থেকে কলা, আম, আনারসের পরেই কাঁঠালের অবস্থান।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে দেশে এত ফল থাকতে কাঁঠাল কেন জাতীয় ফল? কারণ শুধুমাত্র কাঁঠালই জাতীয় ফলের যথার্থতা বহন করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম। তার মতে..

প্রকৃতপক্ষে ভারত উপমহাদেশে বিশেষত বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্ত দেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ব্রাজিলের কিছু অংশ এবং অষ্ট্রেলিয়ার কৃইন্সল্যান্ডে কাঠালের চাষ হয়ে থাকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ১৫১ একর জমিতে কাঠাঁলের উৎপাদন ছিল ১০ লক্ষ ৬০ হাজার টন। আমাদের দেশের সর্বত্রই কম বেশি কাঁঠালের চাষ হয়। তবে ঢাকার উচু অঞ্চল, সাভার, ময়মনসিংহের ভালুকা, নরসিংদী, ভাওয়াল ও মধুপুরের গড়, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, রংপুর, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় প্রচুর পরিমাণ কাঁঠাল উৎপন্ন হয়।

কাঁঠাল একটি মৌসুমী ফল। কাঁঠালের বৈজ্ঞানিক নাম Artocarpus heterophyllus. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের কাঁঠাল পাওয়া যায়। তন্মধ্যে চাউলা, গিলা, খাজা ইত্যাদি অন্যতম। আমাদের দেশের নিচু অঞ্চলগুলোতে কাঠাল উৎপাদন কম হয়। গছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে গাছ মরে যায়। তাই নিচু এলাকায় কাঁঠাল কম হয়। সুতরাং কাঁঠাল গাছের চারা উচু জায়গায় লাগতে হবে যেন সেখানে পানি না উঠে এবং পানি জমে না থাকে।

আমাদের দেশে প্রায়ই বন্যা হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোন কোন অঞ্চল প্রতি বছরই পানির নিচে চলে যায়। ফলে খাদ্যশস্যসহ অর্থকরী ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ধ্বংস হয় বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা। তার মধ্যে কাঁঠাল গাছের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য ঁেবচে থাকা গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপশি নার্সারি বা বাজার থেকে ভাল জাতের নতুন চারা সংগ্রহ করে অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় রোপন করে কাঁঠালের উৎপাদন বাড়ানো যায়।

কাঁঠালকে গরিবের পুষ্টি বলা হয়। কারণ এত সস্তায় এত পুষ্টি উপাদান আর কোন ফলে পাওয়া যায় না। কাঁঠাল খনিজ পদার্থ, ভিটামিন, শর্করার ইত্যাদির মত নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের উৎস হিসেবে কাজ করে। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালে কাঁচা অবস্থায় ৯.৪ গ্রাম এবং পাকা অবস্থায় ১৮.৯ গ্রাম শর্করা, কাঁচা অবস্থায় ২.৬ গ্রাম এবং পাকা অবস্থায় ২.০ গ্রাম আমিষ, কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় ১.১ গ্রাম খনিজ লবন এবং যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন পাওয়া যায়। কাঁঠাল রান্না করা ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় বলে এর পুষ্টি উপাদান অবিকৃত অবস্থায় দেহে শোষিত হয়। কাঁঠালের এসব পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরের গঠন শক্তি উৎপাদন এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

কাঁঠাল কাঁচা এবং পাকা উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত কাঁচা কাঁঠাল সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাকা কাাঁঠাল অনেক পুষ্টিকর কিন্তু এর গন্ধ অনেকের কাছে পছন্দ না হলেও এর মৃদু অম্ল যুক্ত সুমিষ্ট স্বাদের জন্য অনেকে পছন্দ করেন। কাঁঠালের বীচি তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া যায় এবং পুড়িয়ে বাদামের মত খাওয়া যায়। পাকা ফলের কোষ বা কোয়া সাধারণত খাওয়া হয়। এই কোয়া থেকে রস বের করে আমসত্ত্বের মত কাঁঠাল সত্ত্ব তৈরি করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ কাঁঠালের উপর গবেষণা করে অনেক কাঁঠাল জাত দ্রব সফল ভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্যাম, জেলি, কেন্ডিজ, নেকটার, মারমালেড ইত্যাদি অন্যতম। কাঁঠালের বীচির পাউডার গমের ময়দার সাথে মিশিয়ে বিস্কুট, কেক ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে যা অনেক সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। কাঁঠালের কোষ খাওয়ার পর যে খোসা বা রিন্ড থাকে তা গবাদি পশুর উত্তম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাঁঠালের খোসা ও রিন্ডে যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন আছে। এই পেকটিন সহজে সংগ্রহ করে জেলি বা জ্যাম তৈরিতে ব্যবাহার করা যেতে পারে। কাঁঠাল গাছের মূল্যবান কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। সর্বোপরি বলা যায় কাঁঠালই একমাত্র ফল যা কাঁচা-পাকা সর্ব অবস্থায়ই সব অংশ ব্যবহৃত হয়।

দীর্ঘমেয়াদি ফলের মতোই কাঁঠাল গাছের বৃদ্ধি ও ফল ধরতে অনেক সময় লাগে। বসন্তের শুরু থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত কাঁচা কাঁঠাল খাওয়া যায়। সাধারণত জৈষ্ঠ-আষাড় মাসে কাঁঠাল পাকা শুরু হয়। পরিপুষ্ট কাঁঠাল লাঠি দিয়ে আঘাত করতে ডেব ডেব শব্দ হয় এবং আমরা কাঁঠালের পরিপক্বতা বুঝতে পারি। পরিপুষ্ট ফল সংগ্রেহের পর মেঝের ওপর খড় বিছিয়ে সাজিয়ে রাখলেই ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। কাঁঠালকে কখনো হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায় না। তবে ১১ থেকে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ আর্দ্রতাযুক্ত ঘরে একে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

আমরা কাঁঠালের কোয়া বা কোষকে ক্যানিং করে রাখতে পারি। কিন্তু এতে খরচের পরিমাণ বেড়ে যাবে। যা পরবর্তী সময়ে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রিয় বা ক্রয় করতে হবে। এ কথা আজ সুস্পষ্ট যে, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের হাতের নাগালে চলে এসেছে। বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা এক ঋতুর ফল অন্য ঋতুতে এমনকি একই ফল দিয়ে বিভিন্ন মজাদার খাদ্য তৈরি করে খেতে পারি। কাঁঠালও এমনি একটি ফল যা সংরক্ষণ করে বছরের সব সময় বিভিন্নভাবে খেতে পারি।

Exit mobile version