কৃষিসংবাদ

প্রয়োজন হলে সীমিত পরিমাণে চাল আমদানি করা হবে -কৃষিমন্ত্রী

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম যুগোপযোগী

চাল আমদানি

কৃষি সংবাদ ডেস্কঃ

চাল আমদানি ঃ আপাতত দেশে খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক, এমপি বলেছেন, আউশ আমনে চলমান বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও আমনের উৎপাদনসহ সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিদিন নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজন হলে সীমিত পরিমাণে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, চলমান বন্যায় আউশের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমন ধানও অনেকক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। খরার কারণে অনেক সময় উৎপাদন আশানুরূপ হয় না। আউশ আমনে চলমান বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও আমনের উৎপাদন পর্যালোচনা করে প্রয়োজন হলে সীমিত আকারে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে যদি আমনের ফলন ভাল না হয়, বন্যা প্রলম্বিত হয়, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ঠিকমতো কাটিয়ে ওঠা না যায়, তবে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। মন্ত্রী রবিবার বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা: বাংলাদেশ কী চাল ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে?’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারে  প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথা বলেন।

এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, এমপি। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কৃষিসচিব মো: নাসিরুজ্জামান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো: শাহাজাহান কবীর। মুখ্য আলোচক ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষিতে চলমান বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সব ধরনের কার্যক্রম চলছে। আমন মৌসুমে উৎপাদন বাড়াতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, আগামী রবি মৌসুমের সব ফসলে উৎপাদন বাড়াতে পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যাতে করে করোনা, আম্পান, ও চলমান বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

চাল আমদানি নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, এমপি বলেন, কোভিড-১৯ সময়েও মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার মনমানসিকতা সবার নেই। একটা গ্রুপ রয়েছে যারা সুযোগ পেলেই চালের দাম বাড়িয়ে দেয়,কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্ঠা করে। আমাদেরকে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থকেই গুরুত্ব দিতে হবে। এই দুয়ের মাঝে সমন্বয় করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে সরকারি মজুদ সঠিক পরিমাণ রাখতে হবে।

এ অনলাইন সভায় খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ‎প্রফেসর ড. লুৎফুল হাসান, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. হোমনাথ ভান্ডারি, এফএও বাংলাদেশ প্রতিনিধি, প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এসময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অধীনস্ত সকল দপ্তর/সংস্থার প্রধানগণ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, এনজিও এবং এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ এতে সংযুক্ত ছিলেন।

১. দেশে খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই, নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫.৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে-ব্রির গবেষণার তথ্য

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গতবছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।  গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত  উৎপাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০.৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মেটানোর পরেও ৫.৫৫ মিলিয়ন টন চাল দেশের অভ্যন্তরে উদ্বৃত্ত থাকবে। নভেম্বর পর্যন্ত ১৬.৫০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটানোর পরেও ৩৬-৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া, নভেম্বরের মধ্যে দেশের ফুড বাস্কেটে নতুনভাবে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হবে। ফলে, বাংলাদেশে আপাতত খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই।

ব্রি কোভিড-১৯ সময়কালীন খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি, ধানের উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা এবং উৎপাদনে বৃদ্ধিতে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে এই ওয়েবিনার আয়োজন করে। কোভিড-১৯ কালীন ও তৎপরবর্তী দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটি দেশি-বিদেশি সংস্থার বরাত দিয়ে অনেক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রচারিত হচ্ছে যা জনমনে এবং পলিসি লেভেলে অস্বস্তি তৈরি করছে। ব্রি মনে করে, এই ওয়েবিনার দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্ভূত সকল বিভ্রান্তি নিরসন করবে। 

ওয়েবিনারে বলা হয়, ব্রি মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত ৫টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এগুলোর মধ্যে হাওরের ধান কর্তনে শ্রমিক ও যান্ত্রিকীকরণের ভূমিকা, সুপার-সাইক্লোন আম্ফানের প্রভাব নিরূপণ, ধান চালের মজুদ পরিস্থিতি এবং বাজারমূল্যে এর প্রভাব, ৬৪ জেলায় কৃষকের মাঠের ফসল কর্তন এবং আউশ আবাদ পরিস্থিতি নিয়ে র‌্যাপিড সার্ভের মাধ্যমে করোনাকালীন সময়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এসব গবেষণার ফলন বিশ্লেষণে ৬৪টি জেলায় ব্রি কর্তৃক ১ হাজার ৪৮টি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৬৯টি ফসল কর্তনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।  এই সার্ভে কার্যক্রমে দেশের ৩৮টি জেলার ৫৭টি উপজেলা এবং ফসল কর্তনে ৬৪টি জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২. কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও দেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে

ওয়েবিনারে বিগত দশ বছরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর উৎপাদন চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ২০১০ সালে যেখানে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল চতুর্থ। বর্তমানে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, গবেষণা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল একটি অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় মাইলফলক।  যদিও ইউএসডিএ ধানের উৎপাদন নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, গত বছরের তুলনায় উৎপাদন ০.২৮ ভাগ কমে যাবে, কিন্তু বাস্তবে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০ সালে ৩৮.৭ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে।

ব্রির জরিপ থেকে দেখা গেছে, ফলন, আবাদকৃত এলাকা, উৎপাদন ও চালের অভ্যন্তরীণ মজুদ পরিস্থিতি বিবেচনায় গত বছরের তুলনায় এবছর সকল কৃষি অঞ্চলে ধানের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ বৃদ্ধির হার সারাদেশে গড়ে শতকরা ৮.৪ ভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) ৬৪ জেলার ক্রপ-কাট এর ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, ধানের ফলন গড়ে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ব্রি’র ১ হাজার ৪৮টি কৃষকের মাঠে ক্রপ-কাট এর ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সারাদেশে ধানের ফলন গড়ে ২.৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্রির গবেষণায় দেখা যায় চালের উৎপাদন গতবছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরপক্ষে, ডিএই’র ক্রপ কাটের তথ্য অনুযায়ী ৩.১৮ শতাংশ এবং ব্রি’র ক্রপ কাট অনুযায়ী ৩.৯৪ শতাংশ চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বোরো মওসুমে এবছর চালের উৎপাদন হয়েছে ২০.২৬ মিলিয়ন টন যা গতবছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৮ শতাংশ বেশি। এই উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভালো আবহাওয়া, উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা, দাম কমানোর ফলে ডিএপি সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্রি-ডিএই যৌথ উদ্যোগে ১৪টি কৃষি অঞ্চলে আঞ্চলিক কর্মশালা, বোরো মওসুমের শুরুতে কৃষক প্রশিক্ষণ এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

এবছর বোরো ধানের দাম বেশি থাকায় কৃষক আউশ চাষে ঝুঁকেছে। ফলে গতবছরের তুলনায় প্রায় ১৮ ভাগ বেশি জমিতে আউশ ধান আবাদ হয়েছে। আউশের প্রত্যাশিত (expected) উৎপাদন হবে ৩.৫৬ মিলিয়ন টন। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ৩১টি জেলা বন্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাই বন্যার ফলে আউশের প্রত্যাশিত উৎপাদন কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৩. এবার বোরো ধান চাষ লাভজনক ছিল

বিসিআর ক্যালকুলেট করে দেখা গেছে এবার বোরো ধান চাষ লাভজনক ছিল। ধান কাটা মওসুমে কাঁচা ধানের দাম গত বছরের তুলনায় বেশি থাকায় কৃষকের মোট আয় শতকরা ১৬.৭ ভাগ বেড়েছে। বোরো ধান চাষীদের তথ্য মতে, এবছর তারা গড়ে বিঘাপ্রতি ১ হাজার ৬০৪ টাকা লাভ করেছেন যেখানে গতবছর তাদের লোকসান গুণতে হয়েছিল। এবছর কর্তনকালীন সময়ে এবং ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে কৃষক গতবছরের তুলনায় কম পরিমাণ ধান বাজারে বিক্রয় করেছেন। একদিকে ভবিষ্যৎ খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা অন্যদিকে ধানের দাম বেশি থাকায় অল্প ধান বেচেই কৃষক কৃষি ও পরিবারের খরচ বহন করতে পেরেছেন। অধিকন্তু বেশি দামের আশায় ধান মজুদ করার প্রবণতা বাড়তে দেখা গিয়েছে।

৪. ধান-চাল মজুদের প্রবণতা কিছুটা বেশি থাকলেও সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়নি

ধান চালের মজুদ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ধানের ক্ষেত্রে গতবছর জুন মাসে কৃষকের গোলায় মোট মজুদের ২০ শতাংশ ধান ছিল, যা এবছর একই সময়ে প্রায় ২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে অধিক লাভের আশায় একধরনের নতুন বিনিয়োগকারী (Market Actor) যোগ হয়েছে, যারা এসময় ধানে বিনিয়োগকে নিরাপদ মনে করছে। এসব কারণে এবছর মিলারদের ধান মজুদের পরিমাণ গতবছরের তুলনায় কিছুটা কম ছিল।

অন্যদিকে চাল মজুদের বেলায় দেখা যায় যে, ভোক্তাশ্রেণি ভবিষ্যৎ খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা থেকে আতঙ্কিত হয়ে বেশি পরিমাণ চাল মজুদ করেছেন। অপরপক্ষে, সরকারসহ (গতবছর জুন পর্যন্ত সরকারি মজুদ ছিল ১২.৫৬ লক্ষ টন যা এবার কমে (জুন মাসে) ৯.২৭ লক্ষ টনে দাড়িয়েছে) অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীরা গতবছরের তুলনায় কম পরিমাণে চাল মজুদ করেছেন। সার্বিকভাবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ধান-চাল মজুদের প্রবণতা কিছুটা বেশি থাকলেও সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়নি।

৫. সরকার ঘোষিত দামে চাল বিক্রি করে মিলাররা লাভবান হচ্ছেন

চাল উৎপাদন খরচের ক্ষেত্রে মওসুমে বিদ্যমান সর্বনিম্ন দামে মিলাররা যে ধান ক্রয় করেন সেটি থেকে কেজি প্রতি চাল উৎপাদনে ২৭.৮৬ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে সর্বোচ্চ দাম বিবেচনায় দেখা যায় কেজি প্রতি চাল উৎপাদনে ৩৫.৮০ টাকা খরচ হয়। গড় বিবেচনায় এক কেজি চাল উৎপাদনে ৩২.৩৪ টাকা ব্যয় হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদ্যুৎ বিল, যানবাহন ও শ্রমিক খরচ বাড়ার কারণে এবছর মিলিং খরচ ৮.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বাড়লেও এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, সরকার ঘোষিত দামে চাল বিক্রি করে মিলাররা লাভবান হচ্ছেন।

Exit mobile version