কৃষিসংবাদ

বানিজ্যিকভাবে মৌমাছির চাষাবাদ: মধু চাষে অনেক লাভ

GAIBANDHA PIC_0003কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে সরিষা ক্ষেত থেকে বিনা খরচে মধু সংগ্রহ লাভজনক ব্যবসা হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে কৃষকের একদিকে মধু বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অন্যদিকে ক্ষেতে মধু চাষ করায় সরিষার ফলনও পাবে বেশি। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় চলতি বছরে উপজেলায় সরিষা ক্ষেতে মধু চাষের আটটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে। কোনো দুযোর্গ না এলে সরিষায় বাম্পার ফলনের পাশাপাশি কয়েক হাজার টন মধু সংগ্রহ করতে পারবে কৃষক। সরিষা ক্ষেতে মধু চাষে উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
রৌমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আজিজুল হক জানান, সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি থাকলে তা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফলন বাড়ে। এতে সরিষার ফুলে মৌমাছি যে পরাগায়ন ঘটায় তাতে সরিষার দানা ভালো হয় এবং ফলনও বাড়ে। যে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি নেই সেখানে সরিষার ফলন কম হয়। সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার গড়ে তোলার জন্য আমরা সব সময় কৃষককে উৎসাহ দেই। এর ফলে কৃষক দুদিক থেকে লাভবান হয়। একদিকে সরিষা থেকে যে মধু পাওয়া যাবে তা বিক্রি করে অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান অন্যদিকে সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি থাকায় সরিষার ফলন বেশি। এ বছর উপজেলায় আটটি মধুর খামার গড়ে তুলেছে কৃষক। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার গড়ে তোলার প্রচলন ছিল না। গত বছর ফরহাত হোসেনের নামের এক কৃষক সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ করে লাভবান হয়েছে। গত ওই খামার দেখে অনেকেই মধু চাষে আগ্রহ দেখায়। এর ফলে এ বছর আটটি খামার শুরু করা হয়েছে। সরিষা ক্ষেতে মধু চাষ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দিতে হলে সরকারি ভাবে কৃষকদের মাঝে সতেনতা সৃষ্টি, পুঁজির যোগান, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং মধু বিপননের ব্যবস্থা করতে হবে। মূলত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে সরিষা ক্ষেতে মধুর খামার করতে পারছে না কৃষক। তাছাড়া ওই খামার যে ব্যাপক লাভজনক সেটাও জানে না অনেক স্থানের কৃষক। কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলায় যে পরিমাণ জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে তার অর্ধেক চাষ হয় রৌমারীতে। এ বছরও উপজেলার পূর্বাঞ্চল সীমান্ত এলাকা গুলোতে প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। রৌমারী কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে ওই তথ্য।
সরেজমিনে সরিষা ক্ষেতে মধুর খামারে দেখা গেছে, সরিষা ক্ষেতের পাশেই সারি বদ্ধভাবে বসানো হয়েছে মৌমাছির বাক্স। হাজার হাজার মৌমাছি হলুদ রঙের সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে জমা করছে। ৭/৮ দিন পর পর ওই সব বাক্স থেকে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতি বাক্সে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মৌমাছি আর একটি মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। রানী মৌমাছি ডিম দেয়। মৌমাছির নাম ‘এফিস মিলি ফেরা’ জাতের মাছি। সারাদিন মাছি গুলো সরিষার ফুলে পরাগায়ন ঘটায় এবং মধু সংগ্রহ করে। এতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরের সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করে মাছি গুলো। ফরহাত হোসেন নামের মধু চাষি জানান, আমার খামারে দেড়শ’র মতো বাক্স রয়েছে। প্রতিবাক্সে ৯/১০টি করে মোমের ফ্রেম রয়েছে। মোমের ফ্রেমে মাছি মধু জমা করে আর রানী মাছি ডিম দেয়। যখন ফ্রেমগুলো মধুতে ভরে যায় তখন বাক্স থেকে ফ্রেম গুলো খুলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাছি মুক্ত করা হয় এবং ড্রামের মধ্যে ঘুরাইয়া (ঘুর্ণায়মান ড্রাম) মধু পৃথক করে নেওয়া হয়। এতে প্রতি বাক্স থেকে ৬/৭ লিটার মধু বের করা যায়। খামার করতে খরচের মধ্যে একটা বাক্স ৬০০ টাকা, একটা মোমের ফ্রেম ৫০০ টাকা। বাক্সভর্তি মৌমাছি নারায়নগঞ্জ থেকে কিনে আনা হয়েছে। সরিষা ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা এসব মধু ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা লিটারে বিক্রি করা যায়। এ বছর তিনি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন। ফরহাতের মতো আরো ৭জন মধু চাষি খামার করেছেন রৌমারীতে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আজিজুল হক বলেন, ‘মধু মধুই। ফুলের ওপর নির্ভর করে মধুর ভিন্নতা। সরিষার ফুল থেকে যে মধু পাওয়া তার দাম একটু কম। সুন্দরবনের মধুর দাম একটু বেশি। রৌমারীতে প্রতিবছর যে পরিমাণ সরিষার আবাদ হয় তাতে অর্থনৈতিক দিক থেকে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য কৃষককে সরকারি বা বেসরকারি ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। মধু চাষে কৃষকের প্রধান সমস্যা পুঁজির অভাব আর বাজারজাত করনের।’

শ্রীনগরের সাতগাঁয়ে মৌমাছির ভেঁ ভোঁ
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের শ্রীনগরের কেসি চৌধুরী রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে আগাতেই রাস্তার দু’পাশের জমিগুলো এখন হলুদ রংয়ে ছেয়ে গেছে। যতদুর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। জেনো মন কেড়ে নেয় হলুদের এই সমারোহ। রাস্তা ধরে প্রায় ১কি.মি. আগালেই বীরতারা ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রাম। এ গ্রামের জমিগুলো এখন হলুদ বর্নে ছেয়ে গেছে। গ্রামের সরিষা জমিগুলো এখন হলুদ ফুলে প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি বদলের সাথে সাথে বদলেছে দেশের জীব বৈচিত্র। আর তাই বহু বছর যে জিনিসটি চোখে পড়ে না, এখানে গেলে তাই দেখা যায়। হলুদ সরিষা জমিতে তাকালেই চোখে পড়বে অসংখ্য মৌমাছি ভেঁ ভোঁ করে উড়ছে। এক সরিষা গাছ থেকে অন্য সরিষা গাছের হলুদ ফুলে উরে উরে মধু সংগ্রহে ব্যাস্ত মৌমাছি। অথচ গোটা মুন্সীগঞ্জ ঘুরে হাতে গোনা কয়েকটি মৌমাছির মৌচাক পাওয়া যাবে তা বলা মুশকিল। কিন্তু এতো মৌমাছি এখানে এলো কোথা থেকে? এর উৎস্য খুজতে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বেড়িয়ে এলো আসল রহস্য। সরিয়া জমির এক কোন সারি সারি বাক্স নিয়ে বসে আছে ঢাকার সুরি টোলার মৌচাষী বেলায়াত হোসেন।প্রতিবারের মত এবারও তিনি তার পোষা মৌমাছিগুলো নিয়ে মধু সংগ্রহে চলে এসেছেন এই সাতগাঁও গ্রামে।
মধু আহরণে বেলায়েত হোসেনের পোষা মৌমাছির ব্যস্ততার জেনো শেষ নেই। তবে মৌমাছিকে এখন আর দূরের কোন বন-বাগানের খোঁজে দীর্ঘ পথ উড়ে যেতে হচ্ছেনা। বেলায়েতের মত এক শ্রেনীর বানিজ্যিক মৌমাছি পালনকারী মৌমাছিদের নিয়ে যাচ্ছে ফসলের ফুল ফোটা জমিতে। সেখানের মধু আহরন করে বাক্সে মৌচাক তৈরী করছে। এতে এক দিকে যেমন মৌমাছি পালনকারী ব্যক্তি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে পাশাপাশি কৃষকও বাড়তি উপার্জনসহ পরাগায়নের মাধমে জমিতে বাড়তি ফসল উৎপাদন করছে। মৌমাছির আহরিত মধু গুলো আবার নিয়ে আসা হচ্ছে নানা কৌশলে। সহজ এই পন্থায় কৃষকেরও হচ্ছে বাড়তি আয়। সরিষা চাষের পাশাপাশি মৌ মাছির খামার বসিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে এখন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার সাতগাঁও গ্রামের কৃষক। বিস্তৃর্ণ জমিতে এখন মনকাড়া সরিষা ফুলের হদলে রংয়ের মেলা। সেখানেই মৌমাছির মধু কর্মযজ্ঞ। দিনভর মৌমাছি তিল তিল করে মধু এনে জমাচ্ছে মৌচাষী বেলায়েত হোসেনের পেতে রাখা বাক্সে। আর সুযোগতম সেই বাক্স থেকে সুকৌশলে মধু কেটে নিয়ে যাচ্ছে মৌচাষী বেলায়েত হোসেন। এই দৃশ্য এখন এখনকার নিত্যদিনকার। হেমন্তের অগ্রায়হন থেকেই এই মধু সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়ে করেছে বেলায়েত। আর আসছে শীতের পৌষে যেন মধু সংগ্রহের ভর মৌসুম। মৌমাছি আর কৃষকের ব্যস্ততা যেন প্রকৃতির নয়নাভিরাম হলুদ রাজ্যে একাবার হয়ে গেছে। ভোরের শিশির বিন্দু ফুলে ফুলে ঝড়ছে। সেই ভোরের সূর্য উঠতেই মৌমাছির মধু আনার ব্যস্ততা শুরু। তা চলে সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত। আর সকাল, দুপুর, বিকাল প্রতিটি ক্ষনেই যেন প্রকৃতির নানা রূপ ভর করে সাতগাঁওয়ের এই মধু পল্লীতে।
ঢাকার সুরি টোলার মৌচাষী বেলায়াত হোসেন বংশ পরম্পরায় বানিজ্যিকভাবে মৌমাছির চাষাবাদ করছেন। ছোট-বড় মিলিয়ে তার ৪টি মৌমাছির ভ্রাম্যমান বাক্সবন্দী খামার রয়েছে। দেশের ৪টি অঞ্চল থেকে তিনি এখন ফসলি জমিতে এসব ভ্রাম্যমান বাক্সবন্দী মৌমাছিগুলোকে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করছেন। এবার ১০২টি বাক্সের এমনই একটি মৌমাছির খামার নিয়ে বসেছেন শ্রীনগরের সাতগাঁও গ্রামের সরিষার জমিতে। মৌমাছিগুলি বাক্স থেকে নির্দিষ্ট পথে বের হয়ে সড়িষা জমির ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসছে বাক্সে। বাক্সের ভিতরে থাকা বিশেষ ফ্রেমে মৌচাকে মধু জমা করছে। প্রতিটি বাক্সে রয়েছে ৭ থেকে ১০টি ফ্রেম।
সরজমিনে সাতগাঁও গ্রামে গিয়ে কথা হয় বেলায়েত হোসেনের কর্মচারী দেলোয়ার হোসেনর সাথে। তিনি জানান,গত ১০-১২ দিন ধরে তারা সাতগাঁও গ্রামের সরিষা জমি থেকে মৌমাছির আহরিত মধু সংগ্রহিত করছেন। প্রতি ৫-৬ দিন পর পর বাক্সের ফ্রেম হতে মৌচাক কেটে এ মধু সংগ্রহ করে চলেছেন। প্রতিটি বাক্সে ১০ থেকে ১২ কেজি মধু পেয়ে থাকেন তারা। গত ৫ বছর ধরে বেলায়েত হোসেন তার ‘মতিমধু’ নামের মৌমাছি প্রকল্প নিয়ে এ অঞ্চলে বানিজ্যিকভাবে মধু সংগ্রহ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বেলায়েতের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ গত ৩ বছর আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মৌ সšে§লনে শ্রেষ্ট জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন সে।
কৃষিবিদ কাজী হাবিবুর রহমান জানান, বহিরবিশ্বে ফসলের পরাগায়নের জন্য এ জাতীয় মৌ চাষীদের অর্থ দিয়ে জমিতে নিয়ে যেতে হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো জমির মালিককে টাকা দিয়ে জমি হতে মধু আরহন করতে হচ্ছে। অনেকটা অসচেতনতা থেকেই কৃষকরা তাদের জমিতে এসব মৌমাছির মধু সংগ্রহে বাধা দিয়ে থাকে। তাদের ধারণ শস্য ক্ষেত হতে মৌমাছি মধু নিয়ে গেলে শস্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে। মৌমাছির এ চাষ শুধু মৌচাষীকেই স্বাবলম্বী করছেনা। বরং দেশের শষ্য উৎপাদ বৃদ্ধি করছে। সরিষা ক্ষেতে মৌমাছি এক ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে অপর ফুলে গিয়ে বসছে। এতে মৌমাছি পায়ে পায়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পরায়গায়ন হচ্ছে। পুরুষ সরিষা ফুল থেকে মেয়ে সরিষা ফুলে পরাগায়ন হয়ে সরিষা পরাগায়ন হয়ে শস্য হচ্ছে পরিপূর্ণ। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ ভাগ। তাই এসব বিষয় নিয়ে কৃষকদের সচেতন করতে জাতীয় উদ্যোগ দরকার তিনি অভিজ্ঞরা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ টন মধু উৎপাদন সম্ভব এবং তা বিদেশে রফতানিরও একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। শুধু মধু নয় রাণী মৌমাছি, মোম ও আঠাও রফতানি সম্ভব। এ মধু দেশের জন্য লাখ-কোটি ডলারের ব্যবসায়ে পরিণত করা সম্ভব। এতে সৃষ্টি হবে বহু কর্মসংস্থান। দেশে মধু চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বছরের ৬ মাস দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মধু সংগ্রহ করা হলেও দেশে মধু প্রক্রিয়াকরণ কোন কারখানা নেই। দেশে মধু প্রক্রিয়া কারখানা তৈরী করে বানিজ্যিকভাবে এ মৌচাষ আরো বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তা বিদেশে রপ্তানি করলে দেশে এ খাত থেকে লাখ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্র অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য সরকারের উচিৎ এ বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার।

গাইবান্ধায় মৌমাছি ভন ভন
বাক্স থেকে হঠাৎ উধাও রানী মৌমাছি। সর্ষে ক্ষেতের পাশে একটি ডোবায় নেমে মৌকর্মীরা নানাভাবে রাণীকে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কত ধরণের কায়দা কৌশলের পর ধরা দিলো রাণী। হাসি ফুটলো মৌকর্মীদের মুখে। তাদের একজন ফুয়াদ হোসেন জানালেন, রাণীর সংস্পর্শ ছাড়া কর্মী মৌমাছিদের ধরে রাখা সম্ভব নয়। রাণীকে পাওয়া না গেলে মধু মৌসুমে এই বাক্স কোন কাজেই আসতো না। দৃশ্যটি গাইবান্ধার ঘাগোয়া ইউনিয়নের পচাড়কুড়া গ্রামে কাটিহারা নদীর তীরবর্তী এলাকার।
ওই এলাকাঘুরে দেখা গেছে, মধুকর্মীদের ব্যস্ততা। রীতিমতো তাবু খাটিয়ে দিনরাত কাজ করে চলেছেন তারা। শুধু ওই গ্রামের শিশু নারী পুরুষরা নয়, জেলা শহর থেকেও মানুষ ছুটছেন মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়া দেখতে। মধু সংগ্রহ মানে মধু উৎসব। চারপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হলুদের রাজ্য। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সর্ষে ফুলের ম ম গন্ধ। ছোট ছোট জমির আইলে অসংখ্য বাক্স বসানো হয়েছে। প্রতিটি বাক্সে হাজার হাজার মৌমাছি। বাক্সের এক কোণ দিয়ে বেরিয়ে কর্মী মৌমাছিরা সর্ষে ফুল থেকে মধু সংগ্রহের পর সঞ্চয় করে এসব বাক্সে। সাত দিন পর মৌকর্মীরা মৌমাছিদের সঞ্চিত মধু সংগ্রহ করেন বিশেষ পদ্ধতিতে।
প্রশিক্ষক ও মৌকর্মীদের নেতা খন্দকার মাহমুদার রহমান মুকুল বললেন, ১ মাস থেকে তারা ওই এলাকায় সর্ষে ফুলের মধু সংগ্রহ করছেন। তিনি বললেন, একেকটি বাক্স থেকে প্রতি সাতদিন পরপর ৫কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যায়। তাদের ৭ সদস্যের ওই টীম গত ১ মাসে পচাড়কুড়া এলাকা থেকে ৬২ মন মধু সংগ্রহ করেছেন। সর্ষে মৌসুমে ২শ’ বাক্স থেকে তাদের টার্গেট রয়েছে অন্তত দেড়শ’ মন মধু সংগ্রহ। টাকার যার মুল্য দাঁড়াবে প্রায় ২৪ লাখ টাকা। তবে এখানেই শেষ নয়। এরপর তিল, তিসি, লিচু এবং বিভিন্ন ফুল থেকেও তারা মধু সংগ্রহ করবেন। সেজন্য তাদের ঘুরতে হবে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
মাথায় বিশেষভাবে নেটের তৈরি মুখোশ পড়ে কাজ করছিলেন মৌচাষী সুরজিৎ কুমার মিহির। তিনি জানালেন, গাইবান্ধা বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর প্রতি ১০ জন মৌচাষীকে একটি করে মেশিন, বাক্স, মুখোশ, হাতুড়ি, বাটাল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নিজেদের বিনিয়োগে তারা গড়ে তুলেছেন একেকটি মৌমাছির খামার। অন্য যেকোন কাজের চাইতে বিনিয়োগ ও সময় দুটোই কম লাগলেও আয় অনেক বেশী। জয়নাল আবেদীন বললেন, অর্থ উপার্জনই একমাত্র কারণ নয়, এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চারও রয়েছে এই পেশায়। দফায় দফায় মৌমাছির কামড় খাবার পরও তারা ক্ষান্ত হননি। বরং সুশৃংখল ও পরিশ্রমী প্রাণী মৌমাছিকে ভালোবেসেছেন। তিনি দেখালেন কর্মী মৌমাছিরা বেরিয়ে যাওয়ার পর কিভাবে স্পাই মাছি সংবাদ পৌছে দেয় সৈনিক মাছিদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে। দলনায়ক মুকুল বললেন, গাইবান্ধার মৌচাষীদের মুল সমস্যা বাজারজাত করা। স্থানীয়ভাবে দু’তিন কেজি বিক্রি করা যাচ্ছে কিন্তু প্রয়োজনে এক সাথে ১০ মণ মধু বিক্রি করা যায় না বললেই চলে। আবার কিছু বেসরকারী কোম্পানীর লোকজন মধু কিনতে আগ্রহী হলেও তাদের নির্ধারিত মুল্য একেবারে কম। তারপরও উপায় না থাকায় তাদের হাতেই কষ্টার্জিত মধু তুলে দিতে হয়। কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ দাউদ হক্কানী বলেন, মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভ’মিকা রাখে। ফসলের উন্নয়নের পাশাপাশি মৌমাছি থেকে মধুও পাওয়া যায়। তাই ক্ষুদ্র এই প্রাণীটি নি:সন্দেহে উপকারী। গাইবান্ধা বিসিক শিল্প নগরীর এজিএম, একেএম মুশফিকুল ইসলাম বলেন, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মৌকর্মীদের উৎপাদিত মধু শতভাগ খাটি তা নিশ্চিন্তেই বলা যায়। সরকার যদি আন্তর্জাতিক ভাবে মধুর বাজার সৃষ্টি করতে পারে তাহলে মৌমাছি চাষের প্রতি মানুষের যেমন আগ্রহ বাড়বে তেমনি বেকার সমস্যাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখকঃ মফস্বল সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version