কৃষিসংবাদ

লাভজনক নার্সারী করার জন্য যেসব বিষয় বিবেচনা করা জরুরী

 nursery managementবাংলাদেশে কৃষির লাভজনক যে সব সেক্টর রয়েছে তার মধ্যে নার্সারী পেশা অন্যতম। যে স্থানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছোটচারা বা উদ্ভিদের কলম উৎপাদন করা হয় এবং  রোপনের পূর্ব পর্যন্ত যত্ন সহকারে পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তাকে নার্সারী বলে। এখানে অতিযত্নের সাথে ফল, ফুল, শাকসবজি ও মসলাসহ যে কোন গাছের চারা ও কলম তৈরী করা হয়।

নার্সারী করার গুরুত্ব

আধুনিক কৃষিতে নার্সারীর গুরুত্ব অপরিসীম। নার্সারী ছাড়া কৃষি কাজ অসম্পূর্ণই বলাচলে। এর প্রধাণ কাজ হলো চারা উৎপাদন ও চারার যত্ন নেয়া। তবে প্রকৃতপক্ষেনার্সারীতে বীজ উৎপাদন, অংগজ চারা উৎপাদন, বি

ভিন্ন রোপন দ্রব্য সংগ্রহ ওসংরক্ষণ, জাত উৎপাদন, ক্ষণস্থায়ী গাছের ব্যবস্থাপনা, স্থায়ী গাছের ও বীজউৎপাদনকারী মাতৃগাছের সঠিক পরিচর্যা করা ইত্যাদি কর্মকান্ড করা হয়।নার্সারি কেবল উন্নতমানের বীজ ও চারার সরবরাহই নিশ্চিত করেনা জনগনেরকর্মসংস্থাসহ পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে। যে এলাকায় ভাল নার্সারী আছে সে এলাকায় গাছ-পালা, ফুল-ফল ও শাক-সবজির সরবরাহ বেশী থাকে। ফলে মানুষের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে। নার্সারীর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। ছোট ছোট নার্সারী থেকে বছরে লাখ লাখটাকা আয় করা সম্ভব। কারণ এক বর্গমিটার জায়গায় কয়েক হাজার চারা উৎপাদন করা যায়। অনেক চারা বিক্রয়ের উপযোগী করতে মাত্র ৩/৪  সপ্তাহ সময় লাগে। আগাম চারা উৎপাদন করতে পারলে লাভও কয়েকগুন বেড়ে যায়। একটি ভাল নার্সারী থেকেঅল্প সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়। তাই নার্সারী স্থাপন করে নিজে লাভবান হওয়া যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং দেশকে সমৃদ্ধশালীকরে গড়ে তোলা যায়।

নার্সারীর প্রকারভেদ

(ক) অর্থনৈতিক বিবেচনায় নার্সারী
১। গার্হস্থ্য নার্সারীঃএইপ্রকারের নার্সারী ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে স্বল্পজায়গায় ব্যক্তি তার নিজ বাড়িতে তৈরী করে থাকে। এতে ব্যক্তি তার প্রয়োজনঅনুযায়ী ফুল, ফল বা বনজ চারা উত্তোলন করে।
২। ব্যবসায়িক নার্সারীঃছোটচারা

বা কলমের চারা উত্তোলন করে বিক্রয়ের জন্য যে নার্সারী স্থাপন করা তাকেব্যবসায়িক নার্সারী বলে। এসব নার্সারীতে ফুল, ফল, সবজি, মসলা ও বনজ চারাতৈরী করে বাজারজাত করে। বর্তমানে উপশহরে, বন্দরে এবং গ্রামাঞ্চলে এ ধরনেরনার্সারী দেখা যায় ।

(খ) ব্যবহার ভিত্তিক নার্সারী
১। ফলের নার্সারীঃনার্সারীতে শুধু ফলের চারা উৎপাদন করা হয়।
২। ফুলের নার্সারীঃশুধু নানা জাতের ফুলের চারা উৎপাদন করা হয়।
৩। বনজ নার্সরীঃশুধুমাত্র বনজ উদ্ভিদ (শাল, মেহগনি, সেগুন, রেইনট্রি ইত্যাদি) এর  চারা উৎপাদন করা হয়।
৪।  সবজি নার্সারীঃবিভিন্ন জাতের শাক

-সবজির চারা উৎপাদন করা হয়।
৫। মসলার নার্সারীঃমসলা ফসলের চারা উৎপাদন করা হয়।
৬। অর্কিড নার্সারীঃশুধুমাত্র নানা জাতের

অর্কিডের চারা উৎপাদন করা হয়।
৭। ক্যাকটাস ও ফার্নের নার্সারীঃক্যাকটাস ও ফার্নের চারা উৎপাদন করা হয়।

(গ) স্থায়িত্বের ভিত্তিতে নার্সারী
১। অস্থায়ী নার্সারীঃ  যেসমস্ত নার্সারী একটি নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট বাগানের জন্য তৈরী করা হয়তাকে অস্থায়ী নার্সারী বলে। অস্থায়ী নার্সারী  সাধারনত বাগান এলাকার নিকটেতৈরী করা হয়। নির্দিষ্ট কর্মকান্ড শেষে এ সকল নার্সারীর কোন অস্তিত্ব থাকেনা।
২। স্থায়ী নার্সারীঃযেনার্সারীতে বছরের পর বছর সব সময় চারা উৎপাদন ও উত্তোলন করা হয় তাকে স্থায়ীনার্সারী বলা হয়। যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে এরূপ বিভিন্ন স্থানে সরকারী ওবেসরকারী পর্যায়ে স্থায়ী নার্সারী স্থাপন করা হয়।
(ঘ) আকার অনুযায়ী
১।ছোট নার্সারী

২।মাঝারী নার্সারী

৩।বড় নার্সারী

নার্সারী স্থাপনের পদক্ষেপ বা ধাপ

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদনের জন্য নিন্মলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনা করতে হবেঃ
১) স্থান নির্বাচন
এমন জায়গায় নার্সারী স্থাপন করতে হবে যেখানে সর্বদিক বিবেচনা করলে স্থানটিনার্সারীর জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং যেখানে নার্সারী স্থাপন করেঅর্থনৈতিকভাবে প্রচুর লাভবান হওয়া যাবে। তাই নার্সারীর জন্য উপযুক্ত স্থাননির্বাচনের ব্যাপারে নিন্ম লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবেঃ
ক) অবস্থান (Location)

নার্সারীর অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নার্সারীটি যেন সহজেই সকলের দৃষ্টিগোচরহয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। তাই এটি অবশ্যই কোন মহাসড়ক, শহর বা বাজারেরপাশে অবস্থিত হতে হবে যেন নার্সারীটি খুজে বের করতে ক্রেতাদের কোন অসুবিধা না হয়। শুধু তাই নয়, সহজে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন স্থানেই নার্সারী প্রতিষ্ঠা করা উচিত। নার্সারীর অবস্থান যেন কোন ঘোপের মধ্যে না হয় যেখানে সব সময় অতিরিক্ত আর্দ্র ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া বিরাজমান।
খ) যোগাযোগ ব্যবস্থা

যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বা রাস্তাঘাট ভাল নয় সেখানে নার্সারী স্থাপন করা উচিত নয়। নার্সারীর সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গ) মাটি

নার্সারীরমাটি অত্যান্ত উর্বর হওয়া বাঞ্ছনীয়। নার্সারী অবশ্যই উঁচু জায়গায় হতে হবেযেন বন্যার পানি নার্সারীতে কখনই প্রবেশ করতে না পারে। নার্সারীর মাটিসুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন যাতে অতিবৃষ্টিতে বীজতলা বা নার্সারী বেডে পানিজমে না থাকে।
ঘ) জমির মূল্য ও সহজলভ্যতা

যেখানেউঁচু জমি সহজে পাওয়া যায় এবং জমির দামও তুলনামূলকভাবে কম অথচ যোগাযোগব্যবস্থা ভাল এমন স্থানে বাণিজ্যিক নার্সারী স্থাপন করলে লাভবান হওয়ারনিশ্চয়তা বেশি থাকে। অনেক জায়গায় বেশি দামেও সুবিধামত বা উপযুক্ত জমি পাওয়াযায় না। তাই নার্সারী স্থাপনের জন্য নির্বাচিত এলাকায় জমির সহজলভ্যতা  এমনকি জমির দামও বিবেচনায় আনতে হবে।
ঙ) পানির সহজলভ্যতা

নার্সারীতেসব সময় পানির প্রয়োজন বিধায় পানির উৎস থেকে নার্সারীর দূরত্ব বাসেচ-সুবিধা আছে কিনা তা বিবেচনায় আনতে হবে। পানি সেচ ও নিকাশের উন্নতব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
চ) অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা

পরিবহন ওবাজারজাতকরণের সুবিধা, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সুবিধা, দক্ষ শ্রমিকেরসহজলভ্যতা, সমভাবাপন্ন আবহাওয়া ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা পূর্বক নার্সারীর জন্য স্থান নির্বাচন করা উচিত।

২) সীমানা নির্ধারণ ও দেয়াল নির্মাণ

প্রয়োজনমতজমি ক্রয় করে বা লীজ নিয়ে প্রথমে সীমানা নির্ধারণ ও নার্সারীর চতুর্দিকেসীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে হবে। এতে নার্সারীর চারপাশে জমির মালিকগনেরসাথে জমি সংক্রান্ত বিবাদ যেমন এড়ানো সহজ হবে তেমনি ত্রয়কৃত জমিতে ত্রুয়কৃতজমিতে দখলসত্বও নিশ্চিত হবে। এছাড়া বিভিন্ন পশুর উপদ্রব থেকে চারা ও কলমকেরক্ষা করার জন্য নার্সারীর চতুর্দিকে বেড়া দেওয়া প্রয়োজন। এই  বেড়াবিভিন্ন রকম হতে পারে। ইট-বালু-সিমেন্টের দেওয়াল, লোহার জালের  বেড়া, জীবন্ত গাছের বেড়া, কাঁটাতারের বেড়া, বাঁশের বেড়া ইত্যাদি।
৩) নার্সারীর নামকরণ ও সাইনবোর্ড লাগানো

নার্সারীর একটি সুন্দর নামকরণ করতে

হবে এবং সামনে সুবিধামত স্থানে আকর্ষনীয় একটি সাইনবোর্ড লাগাতে হবে।
৪) লে-আউট বা নক্‌শা প্রণয়ন

সুপরিকল্পিতভাবেনার্সারী স্থাপনের জন্য কাগজে নার্সারীর লে-আউট বা নক্‌শা প্রণয়ণঅত্যাবশ্যক। নকশায় নার্সারীর বিভিন্ন অংশের অবস্থান নির্দেশিত থাকবে।লে-আউট অনুযায়ী নার্সারী ধীরে ধীরে পূণাঙ্গ রূপ লাভ করবে।

৫) ভূমি উন্নয়নঃ জমির আগা্ছা ও অবাঞ্ছিত গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে এবং জৈব পদার্থ ও কম্পোষ্টসার প্রয়োগ করে নার্সারীর মাটি উর্বর করতে হবে এবং মাটি সমান করে নিতে হবে।

৬) নার্সারীতে বিভিন্ন অংশ চিহ্নিতকরণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ

লে-আউটঅনুযায়ী নার্সারীতে অফিস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ঘরবাড়ী যেমন- শো-রুম, সেলস্‌কাউন্টার, স্টোর রুম, ওয়াকিং শেড, নেট হাউস, কম্পোষ্ট শেড, পলিটানেল ওঅন্য অংশ যেমন- নার্সরীকে ব্লকে বিভক্ত করণ, সীডবেড, পট ইয়ার্ড, পার্কিংইয়ার্ড, পার্কিং প্লেস, সেচ ও নিকাশ নালা, গভীর ও অগভীর নলকূপ, পরিদর্শনরাস্তা, চৌবাচ্চা, মাড়াই চত্বর ইত্যাদির অবস্থান চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমেএগুলো যথাযথভাবে তৈরি করতে হবে।
৭) যন্ত্রাদি ও অন্যান্য দ্রব্যাদি সংগ্রহকরণ

নার্সারীরকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাদি যেমন- কোদাল, ট্রাওয়েল, গার্ডেন ফর্ক, বাডিং নাইফ, সিকেচার, প্রুনিং শীয়ার, করাত, ব্যালেন্স, ডিবলার, হেজ কাটার ওঅন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতে হবে।
৮) জনবল নিয়োগকরণ

ম্যানেজার, দক্ষ মালী ও শ্রমিক, পাহাদার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করতে হবে।
৯) আধুনিক সুবিধাদির ব্যবস্থাকরণ

নার্সারীতেটেলিফোন ও বিদ্যুতের সংযোগ দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, গ্রীনহাউস, ল্যাথ হাউজ, নেট হাউজ, মিষ্ট প্রপাগেটিং ইউনিটইত্যাদি আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০) জার্মপ্লাজম ও অন্যান্য রোপণ দ্রব্য সংগ্রহকরণ

বিভিন্ন ফসলের নামকরা জাতের জার্মপ্লাজম ও অন্যান্য রোপণ দ্রব্য সংগ্রহকরতে হবে এবং অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে সেগুলোকে যথাযথ স্থানে রোপণ করতে হবে।তারপর নার্সারীর কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
১১) নার্সারীর কার্যক্রম চালুকরণ

পরিকল্পিতভাবে নার্সারীর বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করতে হবে।

সূত্রঃ জাতীয় তথ্য বাতায়ন

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version