কৃষিসংবাদ

জেনে রাখা ভাল সজিনার জাদুকরী ভেষজ নানা গুণাগুন


নাহিদ বিন রফিক

সজিনার জাদুকরী ভেষজ নানা গুণাগুন

সজিনা এক বিশেষ ধরনের সবজি। কোনো কোনো এলাকায় সজনা, সজনে কিংবা সাজনা বলে। ইংরেজি নাম ড্রামস্ট্রিক। এছাড়া বিখ্যাত কবিরাজগণ বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেন। যেমন: সুপত্রক, সুখামোদ, রুচিরঞ্জন, শোভারঞ্জন, উপদংশ, দংশমূল, শিগ্রু, মধুশিঘ্রক এবং তীক্ষœগন্ধ। সজিনাগাছ মাঝারি ধরনের বৃক্ষ। সাধারণত ৪০-৫০ ফুট উঁচু হয়। এর কাঠ খুব নরম এবং বাকল আঠাযুক্ত। সজিনা মাঘ-ফাল্গুনে গাছে ফুল আসে। এর রঙ সাদা। ফল পাকে চৈত্র-আষাঢ়ে। ফলের বীজ ক্রিকোণাকার। এর আদি নিবাস ভারত ও পাকিস্তান। সজিনার ডাঁটা উৎকৃষ্ট সবজি আর পাতা হিতকর শাক। ডাঁটার তৈরি রকমারি খাবার যেমন: ডালসজনা, ভর্তা, সরিষাবাটা সজনা, পাতাভাজি, শাকবড়া এবং ফুলের সাথে ডিম ভাজি দারণ রেসিপি! সজিনার ডাঁটা খেতে সুস্বাদু, তবে পাতা ও ফুল তিতা হলেও যথেষ্ঠ পুষ্টিকর। শুধু কী তাই! এতে রয়েছে ভেষজগুণে ভরপুর। সজিনা মুখে রুচি বাড়ায়। তাই রোগীর পথ্য হিসেবে অনন্য। এর বীজ হতে উৎপন্ন তেলের নাম ‘বেন ওয়েল’। মানুষের খাবারের পাশাপাশি পশুখাদ্য, ঘড়ি মেরামত, পানিশোধক, রঙ ও কাগজ তৈরিতে সজিনার ব্যবহার সমাদৃত। বহুগুণে গুণান্বিত সবজির মধ্যে এর স্থান শীর্ষে। এ কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকায় সজিনাকে বলা হয় ‘জাদুর গাছ’। তাই এর গুণের কথা জেনে নেয়া দরকার।

পুষ্টিগুণ

সজিনা কেবল ভিটামিন সি ও ক্যারোটিনসমৃদ্ধ সবজিই নয়, এর অন্য পুষ্টি উপাদানগুলোর পরিমাণও রয়েছে বেশ। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম ডাঁটায় (আহারোপযোগী) আমিষ ৩.২ গ্রাম, শর্করা ১১.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম, লৌহ ৫.৩ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, ভিটামিন এ ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪৫ মিলিগ্রাম, খনিজ লবণ ১.৯ গ্রাম, আঁশ ৪.৮ গ্রাম এবং খাদ্যশক্তি আছে ৬০ কিলোক্যালরি। আর পাতায় রয়েছে ৬.৭ গ্রাম আমিষ, ১২.৫ গ্রাম শর্করা, ৪৪০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭ মিলিগ্রাম লৌহ, ১.৭ গ্রাম চর্বি, ৬৭০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ, ০.০১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ২২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ২.৩ গ্রাম খনিজ লবণ, ০.৯ গ্রাম আঁশ এবং ৯২ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি। শুকনো পাতায় এর পরিমাণ আরো অধিক। সজিনাপাতায় দুধের চেয়েও বেশি ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংক আছে। পুষ্টির পরিমাণ বেশি থাকার কারণে সজিনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ উপাধি দেয়া হয়।

ভেষজগুণ

সজিনা প্রায় তিনশ’ রোগের প্রতিকার এবং প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি ও লিভারকে সচল রাখে। পাশাপাশি ডায়াবেটিস এবং শরীরের কোলেস্টরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের অতিরিক্ত ওজন কমানো, মায়ের দুধের পরিমাণ বাড়ানো, হজমে সহায়তাকরণ এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণেও রাখে বিরাট ভূমিকা। এছাড়া ক্যান্সার, ব্লাডপ্রেসার, অ্যানিমিয়া, কিডনির পাথর, বন্ধ্যাত্ব, হার্ডের ব্যথা, জয়েন্টের ব্যথাসহ আরো নানা রোগের জন্য বেশ উপকারী। শরীরের রক্তশূন্যতা দূর করতে সজিনার ডাঁটা সিদ্ধকরে চিবিয়ে খেতে হয়। এছাড়া কৃমিনাশক ও জ¦রনাশক হিসেবে কাজ করে। ফলের নির্যাস ধনুষ্টংকার, প্যারালাইসিস, যকৃত ও প্লীহাজনিত রোগের উপকার করে। সজিনার পাতা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। জ¦র ও সর্দি সারাতে সজিনাপাতার কার্যকারিতা বেশ। নিয়মিত পাতার রস খেলে শ^াসকষ্ট দূর হয়। পাতা বেটে টিউমার এবং ফোড়ায় ব্যবহার করলে উপকার হয়। দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়ায় কিংবা রক্ত দেখা দিলে পরিমাণমতো পানি দিয়ে সজিনা পাতা গরম করে নিয়মিত দু’তিনবার কুলকুচা করতে হবে। এভাবে ৭/৮ দিন ব্যবহার করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। ৮/১০ ফোঁটা পাতার রস, সে সাথে এক কাপ পরিমাণ দুধ মিশিয়ে খেলে হেঁচকিওঠা বন্ধ হয়ে যাবে। পাকাপাতার ২/৩ চামচ রস খাবারের আগে খেলে উচ্চরক্তচাপ কমে যায়। তবে ডায়াবেটিস রোগীকে এ রস খাওয়ানো যাবে না। কুকুরে কামড়ালে সজিনা পাতা পিষে এর সাথে পরিমাণমতো হলুদ, রসুন, গোলমরিচ ও লবণ মিশিয়ে খেলে বিষ নষ্ট হয়ে যায়। সাপেকাটা রোগীর জন্য এর মূল ও বীজ ব্যবহার হয়। কানসহ শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা হলে কিংবা ফুলে গেলে সজিনার শিকড় বেটে রস বের করে প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। কুষ্ঠ রোগ হলে বীজের তেল বা বীজ বেটে প্রলেপ দিলে ভালো কাজ করে। বাতে আক্রান্ত করলে প্রতিদিন ৪/৫ চা চামচ গাছের ছালের রস খেলে আরাম অনুভব হবে। হাঁপানীর জন্য ফুলের রস বেশ উপকারী। এছাড়া দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে কিডনির পাথর নিমূল করে। ফুল ও ডাঁটা পক্স প্রতিরোধক। মূলের ছাল বেটে প্রলেপ দিলে দাদ (দাউদ) রোগ ভালো হয়। কপালে আঠা মালিশ করলে কিংবা দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে মাথা ব্যথা দূর হয়। খুসকি দূর করতে পাতার রস মাথায় ভালোভাবে ঘষতে হবে।

সজিনার ফল, বিচি, পাতা, ফুল, গাছের বাকল, মূল এবং আঠা প্রতিটি মহামূল্যবান। এসব ব্যবহারে দেহে পুষ্টির অভাব পূরণ হয়। পাশাপাশি শরীরকে রাখে নীরোগ। তাই আসুন, বসতবাড়ির পতিত জায়গায় সজিনা গাছ রোপণ করি। নিজে সুস্থ থাকি। অপরকেও রাখি তরতাজা। এমন সুযোগ সবার যেন হয়।

লেখক: টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ
বেতার, বরিশাল; ই. মেইল: tpnahid@gmail.com

Exit mobile version