মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান,হাবিপ্রবি থেকে
মহান আল্লাহর অতি আদরের সৃষ্টি মানুষ। এই মানুষ আল্লাহর ইবাদত করবে এটায় আল্লাহ চেয়েছেন।আর মানুষকে তার দেহ সুস্থ রাখার জন্য দিয়েছেন অসংখ্য নেয়ামত। দি
নামকরনঃ বাংলায় দুধ,সংস্কৃততে দুগ্ধ ইংরেজিতে দুধের প্রকার ভেদঃ উৎস অনুপাতে দুধ
আট প্রকার যথা: গোদুগ্ধ, মেষদুগ্ধ,ছাগদুগ্ধ, মহিষ দুগ্ধ, উষ্ট্র দুগ্ধ, হস্তি দুগ্ধ,অশ্ব দুগ্ধ ও নারী দুগ্ধ। আমাদের নিবন্ধোক্ত বিষয় হচ্ছে গোদুগ্ধ।
গুণাগুনঃ সমস্ত প্রকার দুধের গুণাগুন প্রায়ই সমধর্মী । এই আট প্রকার দুগ্ধ প্রায়ই মধুর রস, শীতল, স্তন্যবর্ধক,প্রীতিজনক, বৃংহন বৃষ্য, মেধাজনক,বলকারক, মনের হর্ষোৎপাদক, কাশ নাশক, রক্তপিত্ত প্রশমক , ভগ্নসংযোজক, সমুদয় প্রাণধারীর পক্ষে হীতকর বা সাত্ম্য বাতাদি দোষের প্রশমন, শোধন, তৃষ্ণানিবারক, অগ্নির উদ্দিপক এবং ক্ষীন ও ক্ষত রোগীর পক্ষে উপকারি।প্রাচীনকাল থেকেই দুধ মানুষের অতি প্রিয় পানীয়। শাস্ত্রে দুধকে বলা হয়েছে পৃথিবীর অমৃত। দুধ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে দিয়ে শরীরকে রোগমুক্ত রাখে । দুধে ভিটামিন ‘সি’ ছাড়া শরীরের জন্য
প্রয়োজনীয় সবরকমের পোষকতত্ত¦ বিদ্যমান। সে জন্য কিছুদিন আগ পর্যন্তদুধকে পরিপƒর্ণ বা সম্পূর্ণ আহার বলে মনে করা হতো। এখন যদিও দুধকে সম্পূর্ণ আহার বলে মনে করা হয় না তথাপিও দুধযে খুবই পুষ্টিকর খাবার এ সম্পর্কে দ্বিমত নেই।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রথম ও প্রধান খাদ্য হচ্ছে দুধ। দুধ একটি আদর্শ খাদ্য বা পানীয় শিশুরা মায়ের দুধ পান করে অনেক দিন পর্যন্ত জীবন ধারন করে। একজন পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষ ও দুধ পান করে শুধু বেঁচে থাকার উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে। মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার লৌহ উপাদান না থাকায় বাইরে থেকে লৌহ সরবরাহ করলে দুধ খেয়ে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব।মায়ের দুধের পরে সব রকমের দুধের মধ্যে গরুর দুগ্ধই শ্রেষ্ঠ।
মায়ের দুধের পর আমরা জীবনধারনের জন্য যাদের কাছ থেকেই আমাদের অন্যতম জীবনোপকরন পাই তারাই হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তু। মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। জ্ঞানে গুণে বুদ্ধিতে শিক্ষায় মননে মানুষের সমতুল্য কোন প্রাণী সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু সেই শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের খাদ্য তিনি তৈরি করেছেন চতুষ্পদ জন্তুর স্তনে। যে স্তন থেকে চতুষ্পদ জন্তুর বাচ্ছা দুধ খেয়ে জীবন ধারন করে। সেই স্তন থেকেই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য দুধ আহরিত হয়। জীবন ধারনের বেলায় মানুষের জীবন ও পশুর জীবনকে দুধের উপর নির্ভরশীল করে পশুকে স্রষ্টার সৃষ্টির বিশিষ্ট অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে মানুষকে বাধ্য করেছেন।
মানুষ যেমন স্রষ্টার এক সৃষ্টি পশুও তেমনি তারই সৃষ্টি । মর্যাদা হিসেবে মানুষ ও পশুর মাঝে বিরাট ব্যবধান থাকলেও সৃষ্টি হিসেবে মানুষ ও জন্তু স্রষ্টার কাছে সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গাভীর দুধ ও বিভিন্ন প্রকার জন্তুর দুধ মানুষের খাদ্য হিসেবে নির্বাচিত করার মাঝে রয়েছে প্রভুর এক অলৌকিক দর্শন। এক সৃষ্টির প্রতি আরেক সৃষ্টির মায়ারবন্ধন তৈরি করার এক অভুতপূর্ব কৌশল এখানেই নিহিত রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির এক গূঢ় রহস্য। গাভীর দেহ ও স্তন যেন এক স্বয়ংক্রিয় দুগ্ধ উৎপাদনের কারখানা ।
এই কারখানার সাথে মানুষের তৈরি কোন কারখানারই তুলনা হতে পারে না । এ যে আল্লাহর সৃষ্টির এক অপূর্ব কৌশল। পবিত্র বেদ ও পুরানে দুগ্ধকে অত্যন্ত পবিত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গোদুগ্ধকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বিদগ্ধ পন্ডিতগণ জীবনীয় দ্রব্যের মধ্যে গোদুগ্ধকে সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয় বলেছেন। সাথে জ্বরা ও ব্যাধিনাশক রসায়ন বলিয়া নিন্দেশ করিয়াছেন। ইহাকে অলক্ষ¥ী নাশক বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। গোদুগ্ধ সমুদয় গুণযুক্ত বলিয়া সামান্যত ইহাকে ওজোঃ ধাতুর বৃদ্ধি হইয়া থাকে বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা সমস্ত রোগ হারক।
পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে-মানুষকে উদ্দেশ্য করে তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্যে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। আমি তোমাদের পান করাই তাদের উদরিস্থ বস্তু সমুহের মধ্য থেকে। গোবর ও রক্ত নিঃসৃত দুগ্ধ যা পানকারীদের জন্য উপাদেয় (৬৬ঃ১৬) । আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে দুধের মত উপাদেয় খাদ্য আর দ্বিতীয়টি নেই। দুধ একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ খাদ্য। তাই ইহাকে বলা হয় আদর্শ খাদ্য। বিভিন্ন জন্তুর দুধে অবস্থিত বিভিন্ন পদার্থে ও রক্তে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গরুর দুধ হালকা সাদা ,ক্যাঙারুর দুধ লাল ও মহিষের দুধ গাঢ় সাদা। তবে গুণাগুণের দিক থেকে দুধে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। গরুর দুধ,ছাগলের দুধ ও মহিষের দুধের শতকরা একশ ভাগ অংশই পানের উপযোগী।
গরুর দুধে জলীয়াংশ থাকে ৮৭৫ গ্রাম,ছাগলের দুধে ৮৬৮ গ্রাম ও মহিষের দুধে ৮১ গ্রাম। এর কারণে দুধ তরল থাকে এবং দুধ কমবেশি ঘনত্ব প্রাপ্ত হয়। গরুর দুধে আমিষ থাকে ৩২ গ্রাম,ছাগীর দুধে ৩৩ গ্রাম,মহিষের দুধে ৪৩ গ্রাম। গরুর এবং ছাগীর দুধে আমিষের পরিমাণের পার্থক্য নগণ্য হলে ও মহিষের দুধের পার্থক্য একটু বেশি।
আমিষ মনের দেহের ক্ষয়পূরণ করে দেহের বৃদ্ধি ঘটিয়ে পুষ্টি সাধন করে। জারকরস,হরমোন,কিছু শক্তি ও তাপ উৎপাদনে সহায়তা করে । রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে, মাংসপেশি গঠনে সাহায্য করে। আমিষের উদ্বৃত্ত অংশ শর্করা বা চর্বিতে পরিণত হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রামে গরুর দুধে চর্বির পরিমাণ ৪১ গ্রাম, ছাগীর দুধে ৪৫ গ্রাম, মহিষের দুধে ৮৮ গ্রাম।
চর্বি মানব শরীরে শক্তি ও তাপ উৎপাদন করে, চর্মের কোমলতা বৃদ্ধি করে ,চর্মের উজ্জ¦লতা বৃদ্ধি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দুধে বিভিন্ন প্রকার খনিজ পদার্থ ও বিদ্যমান । এর হার সকল প্রকার দুধেই সমান অর্থাৎ ০৮ গ্রাম। খনিজ পদার্থ দেহ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। গরুর দুধে শর্করা জাতীয় পদার্থ থাকে ৪৪ গ্রাম , ছাগলের দুুধে ৪৬ গ্রাম এবং মহিষের দুধে ৫ গ্রাম । শর্করা দেহে তাপ ও শক্তি উৎপাদন করে দেহের ওজন বাড়ায়। গোদুগ্ধে ক্যালরির পরিমাণ ৬৭ ,ছাগীদুগ্ধে ৭২ এবং মহিষের দুধে ১১৭ । মহিষের দুগ্ধ এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্যালরি সরবরাহ করে থাকে । ক্যালরি হচ্ছে শক্তির একক। মানুষ ভিটামিনে র অভাবে মারা যায় না কিন্তু ক্যালরির অভাবে মারা যায় । দুধ ক্যালরি সরবরাহ করে মানুষকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। এছাড়াও দুধে মূল্যবান অনেক পদার্থ রয়েছে। গোদুগ্ধে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ১২০ মিঃগ্রাঃ, ছাগীর দুধে ১৭০ মিঃগ্রাঃ, মহিষের দুধে ১২০মিঃগ্রাঃ,। ফসফরাসের পরিমাণ গোদুগ্ধে ৯০ মিঃগ্রাঃ, ছাগীর দুধে ১২০ মিঃগ্রাঃ,মহিষের দুধে ১৩০ মিঃ গ্রাঃ । ক্যারোটিন গোদুগ্ধে ৪৯৭ মাইক্রো গ্রাঃ, ছাগীর দুধে ১৮২ মাইক্রো গ্রাঃ,মহিষের দুধে ১৬০ মাইক্রো গ্রাঃ । সকল দুধের সাধারণ গুণ হচ্চে বলবন্দ্ক, আয়ুবন্দ্ক, মেধাবন্দ্ক, স্মৃতিশক্তি বন্দ্ক, শ্রান্তিনাশক, নিদ্রাকারক এবং ত্রিদোষনাশক ।
প্রতি সকালে দুধ পান করলে অগ্নিদিপ্তি শারীরিক পুষ্টি ও শুক্র বৃদ্ধি করে। মধ্যাহে দুগ্ধ পান করলে বল বৃদ্ধি করে ও কফনাশ করে, রাত্রে দুধ পান করলে নানা প্রকার রোগনাশ হয় এবং মাংস ও শক্তি বৃদ্ধিসহ ধাতুর পোষন করে। শৈশব,বাল্য, কিশোর, যৌবন , বার্ধ্যক্য সকল বয়সেই দুধ পান করা হিতকর। গোদুগ্ধ বাতপিত্ত, রক্তদোষ, হƒদরোগ, বেরিবেরি ও ন্যাফ্রাইটিস রোগের উপকার করে। দুধ থেকে তৈরি হয় নানা প্রকার পুষ্টিকর খাদ্য। দুধ থেকে তৈরি হয় দধি, ঘি, মাখন, পনির, ঘোল প্রভৃতি নানা প্রকার মিষ্টিদ্রব্য । বিভিন্ন প্রকার রুচিকর সুস্বাদু খাবার তৈরিতে দুধ ব্যবহƒত হয়। এসব খাবার মানবদেহের জন্য উপাদেয় ও হিতকর। মিষ্টিদই মধুর রস সরবরাহ কারক, শুক্রবন্দ্ক, বায়ুনাশক, রক্তপিত্তের শান্তিদায়ক, পুষ্টিকর ও কফনাশক। ইহা মেদ বৃদ্ধি করতে ও সাহায্য করে। অম্ল বা টক দই অগ্নিবন্দ্ক, পিত্ত,রক্ত ও কফবন্দ্ক মলরোধক। শোথজনক পুষ্টিকর ও অরুচি নাশক। গোদুগ্ধ জাত ঘি অর্থ্যাৎ গব্যঘৃত শরীরের চর্বি সরবরাহের এক শ্রেষ্ঠ উৎস।
ঘি আয়ু দেহের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে , শীত নাশ করে। রক্তপিত্ত নেত্র রোগে ও শুক্র রোগে বিশেষ উপকারী । পুরাতন ঘি মালিশে ব্যাথা নাশ করে। টাটকা ফোটানো দুধ সকলেই খেতে পারেন। যদিও দুধ বেশি ফোটালে পুষ্টিগুণ ] নস্ট হয়ে যায় এবং দুধ হজম করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তবুও দুধের বায়ু প্রকৃতি কমানোর জন্য এবং জীবানু শুন্য করার জন্য দুধ কাঁচা না খেয়ে ফুটিয়ে পান করা উচিত।
যাদের হজম শক্তি দুর্বল এবং ছোট বাচ্চাদেরকে তিন ভাগ দুধে এক ভাগ জল মিশিয়ে তাতে চিনি বা মিছরি সহ খাওয়ানো উচিত , তাতে দুধ সহজ পাচ্য হয়। চিনি বা মিছরি মেশানো দুধ কফকারক কিন্তু বায়ুনাশক। এই দুধ বীর্য বর্ধক এবং ত্রিদোষনাশক, গুড় মেশানো দুধ মুত্র কৃচ্ছতায় উপকার দেয় কিন্তু কফ ও পিত্ত বাড়িয়ে দেয়। গোদুগ্ধ সম্পর্কে আয়ুর্বেদে বলা হয়ে থাকে যে ধারোষ্ণ (সদ্য দোহন করা গরম টাটকা ) দুধ বল বৃদ্ধি করে, হালকা শীতল অমৃত তুল্য অগ্নি প্রদীপ্ত করে ক্ষিধে বাড়িয়ে দেয়, ত্রিদোষ নাশ করে। উম্মাদ রোগের পক্ষে হিতকর।
হাকিমী মতে গোদুগ্ধ পাচক। খাবার হজম করাং, বীর্য উৎপাদন করে , মন ও মস্তিষ্ক প্রসন্ন রাখে, শরীরকে নরম রাখে ও পুষ্ট করে, চেহারা সুন্দর করে, বুদ্ধি বৃদ্ধি করে। জন্ডিস মুর্চ্ছা ,অর্শ, ক্ষয় রোগ এবং বৃদ্ধাবস্থার অসুখে উপকার দেয় । দুধ প্রকৃত পক্ষে মানুষের প্রভুত কল্যাণ সাধন করে। দুগ্ধের উপকারিতা তাই পুরান কোরানও বিজ্ঞানে স্বীকৃত সত্য। সুতরাং সকলে পর্যাপ্ত পরিমাণে গোদুগ্ধ পান করুন। সুস্থ থাকুন ,গাভী নিধন বন্ধ করুন,গাভী পালনে বিশেষ যত্নবান হোন।
দুগ্ধ পান করে সুস্থ্ সবল ও হাস্যোজ্জ¦ল সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিরোগ দেহে বেঁচে থাকুন । তাই আমরা এই স্বাস্থ্যের দুর্যোগের সময় নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধ জাত পন্য গ্রহণ করে স্বাস্থ্য নামক সম্পদকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম