কৃষিসংবাদ

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও পরিবেশ সম্মত বন্ধু চুলা ব্যবহার একটি লাগসই প্রযুক্তি

কৃষিবিদ মো. হামিদুল বন্ধু চুলাইসলাম
আমাদের দেশে রান্নার কাজে জ্বালানী হিসেবে অধিকাংশই আসে কৃষির অবশিষ্টাংশ থেকে। যেমন বিভিন্ন ফসলের গাছ- ধইঞ্চা, পাটকাঠি, বেগুন গাছ, ভূট্টা গাছ, বিভিন্ন ডালের মাড়াইকৃত ভূষি, খড়কূটা, ঘুটে (গরু মহিষের গোবর থেকে তৈরী), ঝোপঝাড়, নলখাগড়া, শন ইত্যাদি। তাছাড়া জ্বালানীর আর একটি বড় উৎস হচ্ছে- গাছের ঝরা পাতা ও বাড়ি, রাস্তা কিংবা বনের কাঠ। গাছের ঝরা পাতা এবং ঘুটের উপর গ্রামের গরীব মানুষেরা অনেকটা নির্ভরশীল। শুধুমাত্র গ্রাম কেন- শহরও গাছের কাঠের উপর সমানভাবে নির্ভরশীল। শতকরা ৬-৭ ভাগ মাত্র পরিবার লাইন কিংবা সিলিন্ডার গ্যাসের আওতায়। রান্নার এ বিশাল পরিমাণ জ্বালানীর যোগান দিতে গিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তাছাড়া কৃষির উপর পড়ছে এর নীতিবাচক প্রভাব। উন্নত দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের (অর্গানিক মেটার) পরিমাণ যেখানে ৫ ভাগের বেশী, সেখানে আমাদের দেশে এর পরিমাণ ১ ভাগেরও কম। দুঃখের বিষয় এই যে, ফসল সংগ্রহের পর জমিতে যে অবশিষ্টাংশ খড়কুটা, ঝরা পাতা, গোচারণের গোবর পর্যন্ত সংগ্রহ করে এক শ্রেণির হতদরিদ্র মানুষ নির্দ্বিধায় চুলাতে পোড়াচ্ছে। মাটি তার জৈব পদার্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে- ফসল ফলাতে আমরা নির্ভরশীল হচ্ছি জীবন বিধ্বংশী বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের উপর।

পরিবেশ বিনষ্টের এই মহড়া থেকে বের হওয়ার একটি সহজ পথ- বন্ধুচুলা (ইমপ্রুভ কুক স্টভ) এর ব্যবহার। বন্ধুচুলায় যদিও বা এই সকল জ্বালানীই ব্যবহৃত হয় তথাপি এই চুলার সঠিক ব্যবহারে প্রচলিত চুলার তুলনায় মাত্র অর্ধেক জ্বালানী লাগে এবং অল্প সময়ে রান্না হয়। বন্ধুচুলার আরেকটি বিশেষ গুণ এই যে, চুলা তৈরীতে ছাঁকনী, লম্বা চিমনি এবং চিমনির মাথায় টুপি থাকার কারণে রান্না ঘর কালি ও ঝুল মুক্ত থাকে। রান্না ঘরের ধোঁয়া স্বাস্থ্য সমস্যার একটা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, দৃষ্টিশক্তির অবনতি, নাক, কান, গলা ও ফুসফুসের প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, সিওপিডি (ক্রণিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিজ), অ্যাজমা, অ্যালার্জি, আলসার, ক্যানসার এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর এক রিপোর্ট (২০০৬) অনুসারে দেশের প্রতি বছর ৩২ হাজার শিশু এবং ১৪ হাজার মহিলা শুধু মাত্র রান্না ঘরের ধোঁয়াজনিত রোগের কারণে মারা যায়। আবার ঘরের বৃদ্ধরাও এই দূষণে বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়। আইসিডিডিআর,বি (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্স, বাংলাদেশ) এর এক রিপোর্টে (২০১২) দেখা গেছে- কাঠ কয়লার চুলার ধোঁয়ার দুষক কণার প্রভাবে দেশের মোট জনগোষ্ঠির ৮০ শতাংশের বেশী শ্বাসতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের ঝুঁকিতে। স্বাস্থ্য সমস্যার এহেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড) যৌথভাবে ‘বন্ধুচুলার বাজার উন্নয়ন উদ্যোগ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের আওতায় দেশে প্রায় ৫ লক্ষ বন্ধুচুলা স্থাপন করা হয়েছে। বন্ধুচুলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এই যে, ইহা গ্রীণ হাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে সাহায্য করে। প্রতিটি বন্ধুচুলা বছরে প্রায় ১.৭ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করে। কিন্তু বন্ধুচুলা ব্যবহারে রান্নাঘর পুরোপুরি দুষণমুক্ত হয় না। এই জন্য রান্নাঘর সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। অবাধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা (ভেন্টিলেশন), পর্যাপ্ত পরিমাণে দরজা-জানালা এবং রান্নার সময় এই সমস্ত দরজা-জানালা উন্মুক্ত রাখা একান্ত প্রয়োজন। রান্নার সময় বাতাসে ধোঁয়া যেদিকে আসে তার বিপরীতে বসে রান্না করা ভালো। রান্না ঘরের ঝুল, কালি ও ধূলাবালি পরিষ্কারের সময় নাকে ও মুখে ভালোভাবে কাপড় যেমন- গামছা, তোয়ালে, শাড়ির আঁচল কিংবা ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে। এসময় আশেপাশে শিশু ও বৃদ্ধরা যেন না থাকে। সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কেননা, ইউএস ইপিএ (ইউনাইটেড স্টেট এনভায়রণমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি) এর রির্পোট অনুসারে, বৃদ্ধ ও শিশুরাই ধুলাবালি দ্বারা বেশী আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে যাদের সিওপিডি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জি রোগ রয়েছে তাদের সবসময় রান্না ঘরের ধোঁয়া, কালি, ঝুল ও ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। এ সকল দুষক কণা থেকে রক্ষার জন্য মাস্ক পরা যেতে পারে। মাস্ক হলো- ফিতার সাহায্যে কানে বা মাথায় জড়ানো নাক ও মুখ ঢাকার সাধারণ মুখোশ। আইওয়া স্টেট ইউনির্ভাসিটির এক্সটেনশন এন্ড আউটরিচ ডিপার্টমেন্টের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে- একপর্দার চেয়ে দ্বি-পর্দাবিশিষ্ট মাস্ক ভালো। মাস্ক পরার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন, এটা নাকে ও মুখে ভালোভাবে সেটে থাকে। কানে বাঁধানো মাস্কের (এয়ার লুপ) ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, এর ফিতা দ্বারা যেন কানে ব্যথা (টাইট ফিটিং) না হয়। মাস্ক ধুলাবালি ধোঁয়া (ফিউমস), পোলেন গ্রেইন, মোল্ডস, ফাংগাল হাইফি, শীতকালে কুয়াশা ও তুষারপাত (ফুসফুসকে) এবং পৌরবর্জ্যরে দুর্গন্ধ থেকে ব্যবহারকারীকে রক্ষা করে। আসুন, আমরা বন্ধুচুলা ব্যবহার করি- ধুলাধোঁয়া থেকে রক্ষায় মাস্ক পরি।

লেখক- কৃষিবিদ মো. হামিদুল ইসলাম।
ফাউন্ডার এন্ড চেয়ারম্যান, মাস্ক ফাউন্ডেশন।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version