উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সম্পূর্ণ শস্য একটি পরীক্ষিত কার্যকরী বিষয়

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সম্পূর্ণ শস্য

মোঃ মামুন-উর-রশিদ ঃ

আক্রান্ত লোকেCrop Seedর সংখ্যার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় রোগ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। এ রোগকে সারা জীবনের অসুখ বলা হয় কেননা একবার এ রোগ হলে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) সারা জীবনে আর ভাল হয় না। তবে আশার কথা এই যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপনের পদ্ধতি এখন অনেকেরই জানা। এ রোগে যেহেতু সারা জীবন কোন না কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াযুক্ত ঔষধ ব্যবহার করতে হয় তাই উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকগণ প্রাথমিকভাবে জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। তবে অনেক ক্ষেএে ঔষধের ব্যাবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যাইহোক এ ব্যাপারে সবাই একমত যে জীবন যাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঔষধের মাত্রা পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি এর কার্যকারিতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া ঔষধের পাশ্ব প্রতিক্রিয়া কমানোর ক্ষেত্রে ও এ পরিবর্তন বিশেষ সহায়ক।
সম্পূর্ণ শস্য  হচ্ছে এমন শস্যদানা যাতে ভ্রুণ (মবৎস), শক্ত বহি:ত্বক (নৎধহ) এবং এন্ডোস্পার্ম অক্ষত থাকে। অন্যভাবে বললে সম্পূর্ণ শস্য হচ্ছে খাদ্য শস্যের সম্পূর্ণ বীজ। অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত শস্য হচ্ছে এমন শস্য যাতে থাকে শুধু এন্ডোস্পার্ম। পরিশোধিত শস্যের পুষ্টি উপাদানের বেশীরভাগই প্রক্রিয়াজাতকরনের সময় নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ শস্য পুষ্টি উপাদানে পরিপূর্ণ যাতে থাকে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি, এন্টিঅক্রিডেন্ট, এবং অন্যান্য মিনারেল যেমন: লৌহ, জিংঙ্ক, কপার এবং ম্যাগনেসিয়াম। আমাদের দেশে প্ওায়া যায় এমন কতগুলো সম্পূর্ণ শস্য হচ্ছে গম, ভূট্টা, কাউন বা মিলেট, ঢেঁকিছাটা চাল, রাই প্রভিৃতি। গবেষকদের মতে সুস্বাস্থের জন্য প্রতিদিন গ্রহণকৃত খাবারের শতকরা ৫০ ভাগ সম্পূর্ণ শস্য হ্ওয়া প্রয়োজন। তবে আমাদের দেশে বিশেষ করে শহরের লোকদের খাদ্যের শতকরা ১ ভাগ সম্পূর্ণ শস্য হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
উচ্চ রক্ত চাপের রয়েছে নানা কারন । তবে বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞানীগণ একমত যে, উচ্চরক্তচাপের অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে রক্তের শর্করার মেটাবলিজমের সমস্যা যাকে বলে ইংরেজিতে বলে ফুংসবঃধনড়ষুংরস। অন্যভাবে বললে ইনসুলিন প্রতিবন্ধকতা  বা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমে য্ওায়া। রক্তের শর্করার মেটাবলিজমের সমস্যার উল্লেখযোগ্য কারনগুলো হচ্ছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ, খাদ্যে প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থের অভাব, ব্যায়াম না করা এবং অতিরিক্ত মুটিয়ে য্ওায়া যার ইরেজি পরিভাষা ড়নবংরঃু।
ইনসুলিন প্রতিবন্ধকতা দুরীকরন এবং গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ শস্য ভিত্তিক খাদ্যের প্রভাব দেখতে দক্ষিণ কোরিয়ার ণড়হংবর বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে একদল রোগীকে ১৬ সপ্তাহ শুধুমাএ সম্পূর্ণ শস্যভিত্তিক খাদ্য প্রদান করা হয়। ফলাফল স্বরূপ দেখা যায় রোগীদের রক্তের শর্করার মাএা শতকরা ২৪ ভাগ, ইনসুলিন লেভেল শতকরা ১৪ ভাগ এবং লিপিড পারঅক্রিডেশন কমেছে শতকরা ২৮ ভাগ। উল্লেখ্য, এক্ষেএে রোগীদের জীবনযাএায় অন্য কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। গবেষণার ফলাফলে বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সম্পূর্ণ শস্যভিত্তিক খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং হার্টের সুস্থতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ৮২৭ জন নারী পুরুষের উপর গবেষণা চালিয়ে তেহরানের শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পরিশোধিত শস্য মেটাবোলিক সিনড্রোমের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে সম্পূর্ণ শস্য এ সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। ২০০২ সালে অসবৎরপধহ ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঈষরহরপধষ গবফরপরহব এর এক নিবন্ধে বিশ্ববিখ্যাত হার্ভাট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ দাবী করেন যে, খাদ্য তালিকায় সম্পূর্ণ শস্য যুক্ত করলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে। তারা র্আও দাবী করেন যে সম্পূর্ণ শস্য টাইপ টু ডায়বেটিস এবং হার্টের রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। তাদের মতে জনসাধারণকে পরিশোধিত শস্য গ্রহণের পরিবর্তে সম্পূর্ণ শস্য গ্রহণে উৎসাহিত করা উচিত। অন্য আরেকটি গবেষণায় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সম্পূর্ণ শস্যে যে আঁশ এবং বাড়তি পুষ্টি উপাদান থাকে তা উচ্চরক্তচাপের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
শুধু উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নয় মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সম্পূর্ণ শস্যভিত্তিক খাবার। আমেরিকার বোস্টনে অবস্থিত সিমন কলেজের একদল গবেষক দশ বছর ধরে ৫০,০০০ মানুষের উপর পরিচালিত গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন যে, সম্পূর্ণ শস্যভিত্তিক খাবার যারা বেশী খান তারা অন্যদের চেয়ে সুস্থ থাকেন। তাছাড়া তাদের উচ্চরক্তচাপ এবং টাইপ টু ডায়বেটিসে আক্রান্ত হ্ওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়। অবার ওজন নিয়ন্ত্রণেও সম্পূর্ণ শস্য ম্যাজিকের মত কাজ করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ শস্যের কার্যকারিতা দেখতে ১২ সপ্তাহ ধরে ৫০ জন মোটা পুরুষ এবং মহিলার উপর একটি পরীক্ষা চালান আমেরিকার পেনসেলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকগণ যার ফলাফল ঝপরবহপব উধরষু, ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শুধু সম্পূর্ণ শস্যভিত্তিক খাবারই নয় এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের অল্প পরিমাণে কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য, পোল্ট্রি এবং মাংস জাতীয় খাবার তাদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়। নিবন্ধে দাবী করা হয় যে, উল্লেখিত সময়ের মধ্যে তারা ৮-১০ পাউন্ড ওজন কমাতে সক্ষম হন।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ডায়েটের ভূমিকা আজ গবেষণায় প্রমাণিত। উরনধঃবং ঈধৎব এর ভলিউম ২৭ এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দেখা যায় যে, উঅঝঐ ডায়েট আমেরিকায় প্রচলিত ডায়েটের চেয়ে অনেক উত্তম। উঅঝঐ ডায়েট হচ্ছে এমন একটি খাদ্য মেনু যাতে থাকে সম্পূর্ণ শস্য, শীম বীজ, শাক-সজ্বি, ফল এবং নিম্ন চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত দ্রব্য। এ ধরনের মেনুতে ফাইবার এবং পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ থাকে বেশী এবং চর্বি ও চিনি জাতীয় পদার্থ থাকে কম। ৫২ জন লোকের উপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায় উঅঝঐ ডায়েট গ্রহণের ফলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে। আরও লক্ষ্য করা যায়, এ ডায়েট গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে রক্তচাপ নাটকীয়ভাবে কমে গেছে।
আসলে সম্পূর্ণ শস্য শুধু ডায়বেটিস আর উচ্চ রক্তচাপই নয় বরং কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা পেটের রোগেরও উপকার করে।তবে আমাদের দেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় সম্পূর্ণ শস্য থাকেনা বললেই চলে। এর প্রধাণতঃ দুটি কারন রয়েছে যার একটি হচ্ছে সচেতনতার অভাব আর অন্যটি হচ্ছে সম্পূর্ণ শস্যের দুস্প্রাপ্যতা। কয়েক দশক আগেও আমাদের দেশের মানুষদের খাদ্য তালিকায় সম্পূর্ণ শস্য জাতীয় খাবার ছিল লক্ষ্যণীয়। তাছাড়া মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে বাজারে সম্পূর্ণ শস্যের দুস্প্রাপ্যতাও রয়েছে। যাইহোক, হাতের কাছে প্ওায়া যায় এমন কয়েকটি সম্পূর্ণ শস্য ভিত্তিক খাদ্য হচ্ছে লাল আটা, পপ কর্ণ, ঢ়েঁকিছাটা চাল এবং ভূট্টা। আসলে বয়স নির্বিশেষে অমাদের তিনবেলা খাবারের অন্তত একবেলা সম্পূর্ণ শস্য ভিত্তিক হ্ওয়া উচিত। এতে একদিকে যেমন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হ্ওয়া যাবে তেমনি হারিয়ে যাওয়া অনেক শস্য ফিরিয়ে আনা যাবে খ্ওায়ার টেবিলে আর স্বাদে অ্্সাবে বৈচিত্র।
(সতর্কতা: এ লেখাটিতে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল একত্রিত করে পাঠকদের সচেতন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। কাজেই, উল্লেখিত গবেষণার ফলাফল দেখে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত ঔষধ খাওয়া বন্ধ করবেন না।)
লেখকঃ
পিএইডি ফেলো ও  সহকারী অধ্যাপক,
কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগ,
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *