কৃষিসংবাদ

ভিয়েতনামে উদ্ভাবিত ওপি জাতের নারিকেলে আশার আলো দেখছে চাষীরা

ওপি জাতের নারিকেলে

মোঃ মোশারফ হোসেন, নকলা (শেরপুর) :

বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে নারিকেল অন্যতম। এই বৃক্ষের ফলসহ প্রতিটি অঙ্গ ছোট-বড় শিল্পের মাধ্যমে বা সরাসরি জনজীবনে কাজে আসছে। পৃথিবীর অপূর্ব সুন্দর গাছের মধ্যে নারিকেল একটি। এটি ‘স্বর্গীয় গাছ’ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত। এদেশে নারিকেলের যেসব জাতের প্রচলন আছে তা মূলত লম্বা জাতের ও কম উৎপাদনশীল এবং ফলন আসতে ৭ থেকে ৯ বছর সময় লাগে। পক্ষান্তরে উচ্চ ফলনশীল ওপি (খাটো) জাতের নারিকেলের ফলন আসতে সময় লাগে মাত্র ৩ থেকে ৪ বছর। দেশের দক্ষিণাঞ্চালের জেলা গুলোতে কয়েক বছর ধরে ভিয়েতনাম থেকে আনা এই নারিকেলের চাষ করা হচ্ছে। উচ্চ ফলন ও উৎপাদনে সময়ের দিক বিবেচনায় সারাদেশ ব্যাপী এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৫ সাল হতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এই নারিকেল চাষ করা হচ্ছে। তার অংশ হিসেবে শেরপুরের নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ওপি (খাটো) জাতের এ নারিকেলে আশার আলো তথা সফলতার স্বপ্ন দেখছেন হাজারো কৃষক।

তথ্য মতে, ২০০৫ সালে ‘সিয়াম গ্রীন কোকোনাট’ ও ‘সিয়াম ব্লু কোকোনাট’ নামের নতুন এজাত দুটি বিশ্ব ব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সব এলাকায় ওপি নারিকেলের চাষ সম্প্রসারণ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছর ব্যাপীফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প ও বিভিন্ন হট্রিকালচার সেন্টার বিণামূল্যে কৃষকদের মাঝে এরচারা বিতরণ করছে। ২০১৬-১৭ সালে উপজেলায় বছর ব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দুই ধাপে ৬১০টি এবং ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী হট্রিকালচার ট্রেনিং সেন্টারের আওতায় ৪০০টি চারা প্রতি কৃষকের মাঝে একটি করে বিতরণ করা হয়। এতে নকলা উপজেলায় ১হাজার ১০জন কৃষকের বাড়িতে ওপি জাতের ভিয়েতনামী নারিকেল গাছ রোপন করা রয়েছে। তাছাড়া নালিতাবাড়ীতে প্রায় ১হাজার ওপি (খাটো) জাতের নারিকেল চারা কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। অনেক কৃষক জেলার বাহিরের বিভিন্ন হট্রিকালচার সেন্টার থেকে প্রতিটি চারা ৫০০ টাকা করে কিনে এনেও লাগিয়েছেন। গাছের বৃদ্ধি দেখে বুকভরা আশা নিয়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

নকলা উপজেলার বাউসা এলাকার একরামূল, শরীফ, হালিমা, কাউসার, শফিক, ফটিক, আসমা; পৌরসভাধীণ জালালপুর এলাকার ঠান্ডু, কডা, সুহেল, খলিল ও হাফিজুর রহমান সহ অনেকেই বলেন, তাদের রোপন করা গাছে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে ফল আসবে। পৌর সভার মেয়র হাফিজুর রহমান লিটনের জালালপুর এলাকার কৃষি বাগানে গিয়ে দেখাযায়, তার বাগানে ৬টি ভিয়েতনামী নারিকেল গাছ খুব সতেজতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। ওই বাগানের তদারক কারী মোঃ হাসমত আলী জানান, গাছের তদারকী বিষয়ে কৃষি অফিস থেকে দেওয়া হ্যান্ডবিল অনুযায়ী ৬ থেকে ৭ মিটার দূরত্বে ১মি.ী ১মি.ী ১মি. মাপের গর্তের মাদায় ২০১৬ সালে গাছ লাগানো হয়েছে। হাসমত বলেন, তাতে ফলন ভালো পেতে প্রতিটি গর্তে ৪০-৫০কেজি পচাঁ গোবর বা জৈব সার, কেজি কেচোঁসার, ২কেজি হাড় বা শুটকির গুড়া, আধা কেজি নিমের খৈল, ৩০০গ্রাম টিএসপি, ৩৫০গ্রাম এমওপি, ১০০গ্রাম জিঙ্ক সালফেট, ২০০গ্রাম বোরন, ৫০গ্রাম ফুরাডান বা বাসুডিন এবং ১০গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক অর্ধেক মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ২ থেকে ৩স প্তাহ বাদে ওই মাদায় চারা রোপন করতে হয়। চারা রোপনের ৩মাস পরে ৪০কেজি পচাঁ গোবর বা জৈব সার, ১০কেজি ছাই, ২কেজি কেচোঁসার, ২কেজি হাড় বা শুটকির গুড়া, ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০গ্রাম টিএসপি, ৬০০গ্রাম এমওপি, ১০০গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম বা জিপসাম এবং ৫০গ্রাম বোরন গ্রয়োগ করতে হয়। দ্বিতীয় বছরে ৫০কেজি পচাঁ গোবর বা জৈব সার, ১০কেজি ছাই, ৩কেজি কেচোঁসার, ২কেজি হাড় বা শুটকির গুড়া, ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৪০০গ্রাম টিএসপি, ৭৫০গ্রাম এমওপি, ১৫০গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম বা জিপসাম এবং ১০০গ্রাম বোরন গ্রয়োগ করতে হয়। তৃতীয় বছরে ৫০কেজি পচাঁ গোবর বা জৈব সার, ১০কেজি ছাই, ৪কেজি কেচোঁসার, ২কেজি হাড় বা শুটকির গুড়া, ১কেজি ইউরিয়া, ৬০০গ্রাম টিএসপি, ১কেজি ২০০গ্রাম এমওপি, ১৫০গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম বা জিপসাম এবং ১০০গ্রাম বোরন গ্রয়োগ করাসহ চতুর্থ বছরে বা উর্ধ্বে ৩০কেজি পচাঁ গোবর বা জৈব সার, ১০কেজি ছাই, ৫কেজি কেচোঁসার, ২কেজি হাড় বা শুটকির গুড়া, ১কেজি ২০০গ্রাম ইউরিয়া, ৮০০গ্রাম টিএসপি, ১কেজি ৪০০গ্রাম এমওপি, ১৫০গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম বা জিপসাম এবং ১০০গ্রাম বোরন নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে রস রাখতে গাছের গোড়া হতে ৮-১০সেমি. ফাঁকে ৮-১০সেমি. পুরুত্বের মালচিং দেওয়া উচিত। পোকা মাকড় এবং বাডরট বা কুড়ি পচাঁ রোধে প্রাথমিক ভাবে প্রতি লিটার পানিতে ৪-৫গ্রাম প্রোপাকোনাজল ও ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক মিশিয়ে কুড়ির গোড়ার ২১দিন পর পর ২-৩বার স্প্রে করতে হবে। ফলপচাঁ রোগে ২গ্রাম হারে এবং পাতার ব্লাইট রোগে পরিমিত সার প্রয়োগ, সেচ ও ষ্কিাশনের ব্যবস্থা থাকাসহ ম্যানকোজেব গ্রুপের রোগনাশক আক্রান্ত ফলে এবং ১৫দিন পর পর ৩বার স্প্রে করতে হবে। গন্ডার পোকা দমনে গাছের ছিদ্রপথে লোহার রড ঢুকিয়ে পোকা বের করতে হবে অথবা ছিদ্র পথে সিরিঞ্জ দিয়ে অরগানো ফসফরাস গ্রুপের কীটনাশক প্রবেশ করাতে পারলেও সুফল পাওয়া যায়। আর নারিকেলের মাইট দমনে তাজা পাতা নাকেটে গাছ পরিষ্কার রাখা উচিত। প্রোপারজাইট গ্রুপের ভার্টিমেক বা ওমাইট ৪.৫মিলি. প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের মাথায় স্প্রে করলে তা সেরে যায়।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ওপি জাতের ‘সিয়াম গ্রিন কোকোনাট’ ’ ও ‘সিয়াম ব্লু কোকোনাট’ নারিকেলটি সর্বপ্রথম ২০০৫ সালে ভিয়েতনামে উদ্ভাবন করা হয়। তারপর ২০১৫ সালে সমুদ্র পথে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে আমদানী করা হয়। এটি ডাব হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেশি উপযোগী। অন্য এক তথ্যমতে, ২০১৫-২০১৬ সালে দুইধাপে খুলনার দৌলতপুর হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভিনদেশী এনারিকেল চারা বাংলাদেশে আনা হয়। ২০১৫ সালে ১হাজার ৮০০টি এবং ২০১৬ সালে ২হাজার ৭০০টি। এগুলোর প্রায় সবকটি চারা প্রতিটি ৫০০ টাকা করে বিক্রি করা শেষ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ‘সিয়াম গ্রিন কোকোনাট’ নারিকেলটির রং সবুজ এবং ‘সিয়াম ব্লু কোকোনাট’ নারিকেলটির রং হালকা হলুদ বর্ণের হয়। প্রতিটি ডাবের ভর ১থেকে দেড় কেজি হয়। পানি হয় ২৫০ মিলি থেকে ৩০০মিলি.। প্রতিটি গাছে ১৫০ থেকে ২০০টি ডাব ধরে। তবে ‘সিয়াম ব্লু’ জাতটি ডাবের জন্য বেশি উপযোগী ও পানি অতি মিষ্টি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর বলেন, নকলার মাটি ওপি জাতের নারিকেল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। অল্প সময়ে ও স্বল্প জায়গায় চাষ করা যায় বলে যেকেউ এই নারিকেল চাষ করে সফল হতে পারেন। এক কৃষক প্রশিক্ষনে এসে স্বাক্ষাতকারে শেরপুর খামার বাড়ীর উপ-পরিচালক আশরাফ উদ্দীন জানান, কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর প্রচেষ্ঠায় শেরপুরে এনারিকেল আনা হয়েছে। জেলার নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ইতি মধ্যে প্রায় ২হাজার চারা কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এই নারিকেল গাছ থেকে পাড়তে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে থেকেই পাড়া যায়। যেহেতু খাটো জাতের সেহেতু পশুর হাত থেকে রক্ষা করতে শক্ত করে ভেড়া দিতে হয়, তাছাড়া কঠিন কোন সেবার প্রয়োজন হয়না। তাই যে কেউ এই নারিকেল চাষ করতে পারে। এই নারিকেল চাষ অতি লাভজনক, তাই কৃষি অফিসের পক্ষথেকে চাষের জন্য কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

Exit mobile version