কৃষিসংবাদ

কার্পাস তুলা চাষে তিনগুণ লাভ

তুলা চাষে তিনগুণ

তুলা চাষে তিনগুণ

মো. মোশারফ হোসাইন, শেরপুর প্রতিনিধি:

তুলা চাষে তিনগুণ ঃ শেরপুরের নকলায় কার্পাস তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন উপজেলার বেশ কিছু কৃষক। চন্দ্রকোণা, পাঠাকাটা ও অষ্টধর ইউনিয়নের অনেক চাষি কার্পাস তুলা চাষ করে খরচের চেয়ে প্রায় তিন গুণ লাভ পাচ্ছেন। তুলা চাষে তিনগুণ লাভ পেয়ে তাদের সংসারে সচ্ছলতা আসায় অন্য ইউনিয়নের চাষিরাও আগ্রহী হচ্ছেন। অনুর্বর জমি ও কম পুঁজিতে নামেমাত্র শ্রমে সরকারি সহযোগিতা পাওয়ায় দিন দিন উপজেলায় তুলা চাষির সংখ্যা ও তুলা চাষের জমির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। অর্ধযুগ আগে তথা ২০১৫ সালে সরকারি পৃষ্টপোশকতায় নকলা উপজেলায় হাইব্রিড প্রজাতি রুপালি-১ কার্পাস তুলা চাষ শুরু করা হয়। এখানের উৎপাদিত তুলা শুরু থেকেই সরাসরি তুলা উন্নয়ন বোর্ড ন্যায্য দামে কিনে নিচ্ছে।

সরকারি সহযোগিতায় ২০১৫ সালে উপজেলায় প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে সরকারি সহায়তায় ১৮ জন এবং ব্যক্তি মালিকানায় অন্তত ২০ জন কৃষক সিবি-১২ এবং হাইব্রিড প্রজাতির রুপালি-১ জাতের তুলার চাষ শুরু করেন। ওই বছর ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের আগ্রহ বেড়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেতে ওই বছর এসিট, জেসিট, আমেরিকান বোলওয়ার্ম, স্পটেট বোলওয়ার্ম ও আঁচা পোকার অক্রমণ দেখা দিয়েছিল। এতে তুলা চাষি কীটনাশকের বদলে ফেরোমন ফাঁদ ও পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ উপকার পেয়েছিলেন। এর পর থেকে যে কোন রোগ-বালাইয়ে তুলা ক্ষেতে কীটনাশকের বদলে পরিবেশ বান্ধব ফেরোমন ফাঁদ ও পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছেন চাষিরা।

নকলা সাব কটন ইউনিট কর্মকর্তা তোফায়েল আলম জানান, চলতি বছর নকলা সাব কটন ইউনিটের আওতায় ৫০ হেক্টর (১২৫ একর) জমিতে তুলা চাষ করা হয়েছে। এতে রুপালি-১ ও সিবি-১২ জাতের তুলা বেশি চাষ করা হয়। উপজেলায় এবছর ১৭ টি প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে তুলা চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি তথা রাজস্ব খাতের আওতায় ৩টি প্রদর্শনীতে এক একর করে মোট ৩ একর এবং সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্পের আওতায় ১৪ টি প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে এক একর করে মোট ১৪ একর জমিতে রুপালি-১ কার্পাস তুলা চাষ করা হয়েছে। তাছাড়া ১০৮ একর জমিতে বিভিন্ন এলাকার কৃষক নিজ অর্থায়নে কার্পাস তুলা চাষ করেছেন। ভালো ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষির সংখ্যা অনেক বাড়বে বলে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও চাষিরা ধারনা করছেন। তারা বলেন, এ দেশে আমেরিকান, ইজিপসিয়ান, ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি জাতের তুলা চাষ হলেও রুপালি-১ জাতের তুলা অধিক ফলনশীল। তাই এখানের কৃষকরা রুপালি-১ জাতের তুলা চাষেই আগ্রহী বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলা চাষ ছড়িয়ে দিতে সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্প (ফেজ-১) সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।

উপজেলার সর্ববৃহৎ তুলা চাষি জাংগীড়ার পাড় গ্রামের আরিফুজ্জামান রঞ্জু, চন্দ্রকোনা ইউনিয়নরে বাছুর আলগা গ্রামের তুলাচাষি সাজু সাঈদ সিদ্দিকী ও নূরে আলম সিদ্দিকী রাজু; হুজুরি কান্দার রমজান আলীসহ অনেকেই জানান- সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে অনেক অনুর্বর ও অনাবাদি জমিতে তুলা চাষ করে যেকোন কৃষক পরিবারের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। তাদের মতে, অনুর্বর জমিতে তুলা চাষ করায় একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যয়ের চেয়ে আয় হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি এবং চাষিরা লাভ পাচ্ছেন প্রায় তিন গুণ।

সাব ইউনিট কর্মকর্তা তোফায়েল আলম বলেন, নকলা উপজেলার মাটি তুলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তাই এ উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়ন এলাকায় তুলা চাষ করা সম্ভব। তিনি জানান, তুলা গ্রীষ্মকালীন ফসল। মে মাসের শেষ ভাগ থেকে জুনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তুলা বীজ বপন করতে হয়। তুলার ভালো ফলনের জন্য গড়ে ২৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ৬৩৫ থেকে ১০১৬ মিলিমিটার হওয়া উত্তম। ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার গভীরতায় চাষ করে হেক্টরপ্রতি ২৭৭ কেজি অস্থিচূর্ণ, ৯.৫ টন থেকে ১৩.৮ টন গোবর বা সবুজ সারসহ পরিমিত পরিমাণে ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি সার ব্যবহার করলে ফলন ভালো হয়। আর জাত ভেদে বীজ বুনতে হয় ৭.৫ থেকে ১৮ কেজি।

টানা কয়েক বছরের সফল তুলা চাষি জাংগীড়ার পাড়ের আরিফুজ্জামান রঞ্জু বলেন, ৬ মাসের ওই ফসল সংগ্রহ করা যায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। বিঘাপ্রতি উৎপাদন হয় বীজসহ ১০ থেকে ১২ মণ, বীজ ছাড়া ৫ থেকে ৬ মণ। যার খোলা বাজারে মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা নেয়ায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড বীজসহ কিনে নেয় ২ হাজার ১০০ টাকা প্রতি মণ হিসেবে। ফলে বিঘাপ্রতি কৃষক দাম পাচ্ছেন ২২ হাজার থেকে ২৬ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি সব মিলিয়ে খরচ হয় ১৩ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। খরচের মধ্যে বিঘাপ্রতি ৬ হাজার টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ফলে কৃষকের পকেট থেকে ব্যয় হচ্ছে বিঘাপ্রতি মাত্র ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। সে হিসাবে কৃষকের বিঘাপ্রতি লাভ হচ্ছে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। এমন জমিতে অন্য কোনো ফসল পাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্যের পরেই বস্ত্রের স্থান। আর এ বস্ত্রের ৭০ ভাগ কাঁচামাল আসে তুলা থেকে। উপজেলায় তুলা চাষে উপযোগী সকল পতিত জমিতে তুলা চাষ করা সম্ভব হলে কৃষি অর্থনীতি সমবৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। ফলে কমবে বেকারত্ব, পক্ষান্তরে বাড়বে স্বাবলম্বীর পারিমাণ। তাই কৃষকদের তুলা চাষে আগ্রহী করতে নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান সাব কটন ইউনিট কর্মকর্তা তোফায়েল আলম ও কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস।

Exit mobile version