কৃষিসংবাদ

ক্ষুদ্র খামারিরাই দুগ্ধ শিল্পে নীরব বিপ্লবের নায়ক

ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারিরাই

নিতাই চন্দ্র রায়
ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারিরাই ঃপ্রগতি হর্টিকালচার নার্সারিতে ম্যানেজারে চাকুরি করত ত্রিশাল উপজেলার কোনাবাড়ি গ্রামের ভুপেন পাল।চাকুরি ছেড়ে এখন নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামার।পুকুরে পাঙ্গাস মাছের চাষও করেন তিনি। খামারে ৪টি উন্নত জাতের গাভী আছে তার। তিনটি গাভী ৫ মাসের গাভীন। প্রতিদিন দুধ দেয় ৮ লিটার। প্রতি লিটার ৬০ টাকা হিসেবে ৪৮০ টাকা আয় করেন দুধ বিক্রি করে তিনি। গাভী পালনে নিজের খেতের খড়, চালের কুড়া, ভাতের মাড় ও পুকুর পাড়ের নেপিয়ার ঘাস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। এতে প্রতিদিন গরুর খাবারের পেছনে খরচ হয় ১০০ টাকা। খরচ বাদে প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে তার নিট লাভ হয় ৩৮০ টাকা। এ টাকাতেই প্রতিদিনের পারিবারিক খরচের একটা অংশ পুরণ করেন তিনি।ভুপেন পালের মতো হাজার হাজার ক্ষুদ্র খামারির অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশে দুগ্ধ শিল্পে ঘটেছে এক নীরব বিপ্লব। এ বিপ্লবের নায়ক হলেন ক্ষুদ্র প্রান্তিক খামারিরা। তাঁদের মেধা, শ্রম ও অধ্যাবসায়ই সম্ভাবনাময় এখাতকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূর।

ধানীখোলা দক্ষিণ ভাটি পাড়া গ্রামের আর একজন ক্ষুদ্র খামারি হলেন আব্দুল ওয়াদুদ। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর আজ থেকে সাত বছর আগে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেন দুগ্ধ খামার। বর্তমানে তার খামারে ১৮ টি গাভী আছে। এর মধ্যে ১৬টিই উন্নত জাতের হলস্টেন ফ্রিজিয়ান ও দুটি দেশী জাতের ক্রস। ১৮টি গরুর মধ্যে ৭টি ৫ থেকে ৬ মাসের গাভীন। এসব গরু থেকে তিনি প্রতিদিন দুধ পান ৪০ লিটার। প্রতিলিটার দুধ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। তাঁর মতে দুধের দাম প্রতিলিটার ৬০ টাকার নিচে হওয়া উচিত নয়। ৬০ টাকা লিটারের কম দামে দুধ বিক্রি করলে খামারিরা লোকসানের সম্মুখীন হন। আব্দুল ওয়াদুদ গো খাদ্য হিসেবে নেপিয়ার ও জাম্বো ঘাসের চাষ করেন।দুধের জন্য কাঁচা ঘাসের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য খামারিদের মধ্যে ঘাস চাষের জন্য উন্নত জাতের ঘাসের বীজ ও কাটিং স্বল্প মূল্যে সরবরাহ এবং ঘাস উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে দুগ্ধ খামারিদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। তিনি দুধ ছাড়াও প্রতিবছর ৩ থেকে ৪টি ষাড় বিক্রি করে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা আয় করেন। এছাড়া গরুর গোবর থেকে তিনি একটি বায়োগ্যাস প্লান্ট চালান । এথেকে তার সংসারের সারা বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ হয় এবং জৈব সারের চাহিদাও মেটে। তাঁর কথা দুগ্ধসহ প্রাণি সম্পদ উন্নয়নের জন্য কৃষি বিভাগের মতো দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একজন করে ডিপ্লোমা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিয়োগ করা প্রয়োজন। যারা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির রোগবালাই দমন, খাবার ও বাসস্থানের ব্যাপারে খামারিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবেন এবং কৃত্রিম প্রজনন কাজে ও
সহায়তা করবেন।
দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি-১২, নিয়াসিন ও রিবোফ্লাভিন। দুধের নানা পুষ্টিগুণ মানুষকে সুস্থ, সবল নিরোগ রাখতে সহায্য করে। এসিডিটি সমস্যা ও কাজের চাপে অস্থির অবস্থা- এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে এক কাপ দুধ। প্রতিদিন মাত্র এক গ্লাস দুধ পানেই এমন অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি আমরা। এ ছাড়া দুধের ক্যাসিয়াম দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে। ভিটামিন ও মিনারেল শরীরকে সুদৃঢ় করে।মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে। দুধ পানে ঘুমের উদ্রেক হয়, যার ফলে মস্তিষ্ক শিথিল থাকে ও মানসিক চাপ মুক্ত হয়। দুধের ভিটামিন ও মিনারেল দেহের ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে । রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত দুধ পানে ত্বক নরম , কোমল ও মসৃণ হয়। দুধ কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখে ও রক্ত পরিস্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রতি বার্ষিক দুধ গ্রহণের পরিমাণ ৫৯ থেকে ৬০ কেজি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে একজন পূর্ণ বয়স্ক লোকের বার্ষিক দুধ গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত কমপক্ষে ৯০ কেজি। সে হিসেবে ১৬ কোটি ৮১ লাখ লোকের বার্ষিক দুধের প্রয়োজন ১ কোটি ৫১ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৯৪ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন দুধ। বাকি চাহিদা বিদেশ থেকে আমদানি করে পূরণ করা হয়। গত ১০ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ।সেই সাথে ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দুগ্ধ খামার। এখন দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে দুগ্ধ খামার রয়েছে প্রায় ১২ লাখ।আর শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় এক কোটি লোক। দুগ্ধ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে নানা উদ্যোগ। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগিয়ে চলছে তাতে আশা করা যায় দুধ উৎপাদনে যে ঘাটতি রয়েছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে তা পূরণ করা সম্ভব হবে। দুধ উৎপাদনের জন্য পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নাটোর যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রাম প্রভৃতি জায়গায় বেশি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও দেশের প্রায় সব জেলায় এ ধরনের খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে অনেক সাহসী ও তরুণ উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশের মোট জাতীয় আয়ে দুগ্ধ শিল্পের অবদান সাড়ে তিন শতাংশ। সম্ভাবনাময় এ শিল্পের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত পরিকল্পনা। শিক্ষিত উদ্যোক্তারা এখন যুক্ত হচ্ছেন এ শিল্পের সাথে।বর্তমানে ডেইরি ফারমার্স অ্যাসেসিয়েশনের সদস্য সংখ্যা ৮১ হাজার, যার মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ¯œাতক পাশ।
দেশীয় খামারিদের সাথে এখন এখাতে যুক্ত হচ্ছে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলো। দুগ্ধ খাতে গড়ে উঠেছে বড় বড় ৮টি কোম্পানি। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড(মিল্ক ভিটা) অনেক আগে থেকেই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সম্প্রতি প্রাণ, ব্র্যাক ও আকিজের মতো প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে গাভীর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের কাজ করছে। এতে দিন দিন খামার ও খামারির সংখ্যা বাড়ছে। আগে দুধ বিক্রি ছিল এখাতে একটি বড় সমস্যা ছিল।দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় কোম্পানিগুলোর দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করায় সে সমস্যা অনেকটা দূর হয়েছে। কোম্পানিগুলো প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত খামারিদের দুধের মূল্য পরিশোধ করে। দুধে ফ্যাট ও ননীর পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে তুলনামূলক বেশি দামে দুধ বিক্রি করতে পারেন খামারিরা। এছাড়া স্বল্প সুদে খামারিদের ঋণের ব্যবস্থা করে কোম্পানিগুলো।

ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারিরাই ঃ ২০১০সালে বাংলাদেশে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ লাখ লিটার । বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে
৯৪ লাখ লিটারে। দেশের অধিকাংশ খামারির দক্ষতার অভাব রয়েছে। তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিগত ১০ বছরে ডেইরি খাতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দুধ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। তবে আরো ভালো প্রযুক্তি ও উন্নতমানের গরু দরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৫৮ হাজার। পশু খাদ্য খাতে খামারের ৭০ শতাংশ খরচ হয়। খাদ্য খরচের পরিমাণ যাতে কমে আসে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।খামারিদের জন্য তরল দুধ প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজার মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা খামারিদের কাছ থেকে কম দামে দুধ কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। তাই উৎপাদনকারী ও ভোক্তা পর্যায়ে দুধের দামের পারতক্য কমিয়ে আনতে হবে।
প্রাণিজ আমিষ হিসেবে দুধের কোনো বিকল্প নেই।দক্ষিণ কোরিয়ার হাসপাতালগুলোতে দুধ খাওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে হাসপাতালে বেডের সঙ্গে সুইচের ব্যবস্থা করা আছে। সুইচ চাপলেই এককাপ দুধ পাঠানো হয় রোগীকে। বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমাদের নিরাপদ দুধ নিশ্চিত করতে হবে। দুধে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে এন্টিবায়োটিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে ভীতিকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। ভিয়েতনামে স্থানীয় খামারিরা আগে তাদের গরুগুলো থেকে দৈনিক ৫ থেকে ৬ লিটার দুধ উৎপাদন করত। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এখন তারা নিজেরাই ১৫ লিটার দুধ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে।


স্কুল পর্যায়ে দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তরল দুধই নয়; দুগ্ধ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে নানা রকম পুষ্টিকর খাবার। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে মিষ্টি ,মাখন, দই, পনির, ঘি, দুগ্ধ জাতীয় পানীয় ও খাদ্য পণ্য যেমন চকোলেট মিল্ক, আম দুধ ইত্যাদি।
নি¤œ মানের গুড়া দুধ আমদানির কারণে খামারিরা দুধের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। তাঁদের দাবি- এক. নি¤œ মানের ভর্তুকিপ্রাপ্ত গুড়া দুধের ওপর এন্ট্রি ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ ও আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা। দুই.গত ১০ বছরে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে খামারিদের তরল দুধের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করণ। তিন. দুধ প্রসেসিং কোম্পানির সাথে সরকার কর্র্তৃক নির্ধারিত দামে তরল দুধের দাম সমন্বয় সাধন করা । চার. এলাকা ভিত্তিক খামারিদের দুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দেয়া । পাঁচ. ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা । ছয়.পোল্ট্রি ও মৎস শিল্পের মতো দুগ্ধ খামারিদের আগামী ২০ বছরে জন্য আয়কর মুক্ত বা ট্যাক্স হলিডে দেওয়া ।সাত. হঠাৎ গরু মারা গেলে খামারিরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন। তাই খামারিদের জন্য বিমার ব্যবস্থা করা। খামারিদের এসব দাবি-দাওয়া সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করলে দুগ্ধ শিল্পে আরো এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতে মেধাবী বাঙালি জাতি বিনির্মাণের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার।পরিশেষে বলতে চাই খামারি ও দেশের বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধে মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক, অণুজীব ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি ভোক্তাদের আতঙ্কিত করে তুলেছে- এথেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজের বের করতে পুষ্টি বিজ্ঞানী, খামারি, পশু খাদ্য ও ওষুদ উৎপাদনকারী কোম্পানি ,দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি ,পশুসম্পদ অধিদপ্তর এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের পশু পালন ও পশু চিকিৎসা অনুষদগুলোকে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম।
লেখকঃ
সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিঃ
গোপালপুর , নাটোর

Exit mobile version