কৃষিসংবাদ

গরু মহিষ ও ছাগল এর নানা রোগব্যাধি ও তার সুব্যবস্থাপনা পর্ব-১


কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ

গরু মহিষ ও ছাগল এর নানা রোগব্যাধি

গরু, মহিষ ও ছাগল ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী দ্বারা সংক্রমিত হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। নিচে গরু, মহিষ ও ছাগলের বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার বর্ণনা করা হলো :
ভাইরাসজনিত রোগঃ গরু, মহিষ ও ছাগলে ক্ষুরা, বসন্ত, জলাতঙ্ক, ও ছাগলের পিপি আর রোগ হয়।

ক্ষুরা রোগ
এরোগ বিভিন্ন এলাকায় বাতা, জ্বরা, এসো, ক্ষুরাচল, ক্ষুরপাকা, তাপা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
কারণ : পিকরানা নামক ভাইরাস সংক্রমণে হয়। ছোঁয়াচে রোগ। রোগাক্রান্ত পশুর সংস্পর্শ, খাদ্যদ্রব্য, লালা ও ব্যবহার্য দ্রব্য ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।
লক্ষণ : ১. জিহবা, মুখের ভিতর, পায়ের ক্ষুরের মাঝখানে, গাভীর ওলানে ফোস্কা ওঠে।
২. ফোস্কা ফেটে ক্ষত হয়। দুর্গন্ধ ছড়ায়।
৩. মুখ ও নাক দিয়ে লালা পড়ে।
৪. পশু খুঁড়িয়ে হাঁটে। দাঁড়িয়ে থাকার সময় পা উঁচু করে রাখে।
৫. ক্ষতে মাছি পড়ে। ক্ষতে পোকা দেখা যায়।
৬. মুখ থেকে চপ চপ শব্দ করে।
৭. দেহের তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ Ñ ১০৬ ফারেনহাইট হয়।
৮. খাওয়ায় অরুচি হয়। শক্ত খাবার খেতে পারে না।
৯. পায়ের ক্ষুর পচে খসে পড়ে।
১০. পা সবসময় ছুড়তে থাকে।

প্রতিরোধ : ১. রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে পৃথক করা।
২. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লালন পালন ব্যবস্থা করা।
৩. পশুর পা কাদা বা পানিতে ভেজানো যাবে না।
৪. সুস্থ পশুর ঘাড়ে চামড়ার নিচে ইনজেকশন করে টিকা দিতে হবে। প্রথম টিকা ২-৩ মাস বয়সে, দ্বিতীয় টিকা এর একমাস পর, তৃতীয় টিকা এর ৩ মাস পর এরপর ৬ মাস পর পর টিকা দিতে হবে।
প্রতিকার : ১. ক্ষত স্থান বিভিন্ন জীবাণুনাশক ওষুধ যেমনÑ স্যাভলন ও ডেটল দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
২. পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ০.১% দ্রবণ বা ফিটকিরি ২% দ্রবণ দ্বারা দিনে ২/৩ বার মুখ ও পা ধুয়ে গ্লিসারিন বা মধুতে ২% বোরিক এসিড মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে।
৩. ক্ষত স্থানে নারিকেল তেল ও তারপিন তেল ৪ঃ১ অনুপাতে মিশিয়ে লাগাতে হয়।
৪. মুখ ও পায়ের ক্ষত খাবার সোডা মেশানো পানি দিয়ে দিনে ৩-৪ বার ধুইয়ে দিতে হবে।

বসন্ত রোগ
কারণ : ভাইরাস সংক্রমণে আক্রমণ হয়।
লক্ষণ : ১. লোমহীন স্থানে ঠোঁট, গলার ভিতর, দাঁতের মাড়ি, জিহবার নিচে ছোট ছোট গুটি উঠে।
২. পরে সমস্ত দেহে ও মুখমণ্ডলে গুটি উঠে।
৩. পশু খাওয়া ও জাবর কাটা বন্ধ করে।
৪. নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
৫. পিপাসা বাড়ে। গাভীর দুধ কমে যায়।
৬. দেহের তাপমাত্রা ১০৪ Ñ ১০৬ ফারেনহাইট হয়।
৭. প্রথমে কোষ্ঠকাঠিন্য হলেও পরে পাতলা মলত্যাগ করে।
৮. পিঠ নিচের দিকে বেঁকে যায়।
৯. পশুর দেহ থেকে বিশ্রি গন্ধ বের হয়।
১০. পশু ৮-১০ দিনের মধ্যে মারা যেতে পারে।
প্রতিরোধ : ১. রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে পৃথক করা।
২. পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লালন পালন ব্যবস্থা করা।
৩. সুস্থ পশুকে বসন্ত রোগের টিকা দিতে হবে।
প্রতিকার : ১. পশুকে বিশুদ্ধ পানি ও পরিষ্কার তরল খাবার খাওয়ানো।
২. পাতলা মলত্যাগ কমাতে এণ্টিবায়োটিক খাওয়ানো যায়।
৩. কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করতে তিসির খৈল খাওয়াতে হবে।

ছাগলের পিপিআর রোগ
কারণ : ভাইরাস সংক্রমণে হয়। এ রোগে ৯০% ছাগল মারা যায়।
লক্ষণ : ১. দেহের তাপমাত্রা বাড়ে। জ্বর হয়।
২. মুখে ও খাদ্য নালীতে ঘা হয় এবং রক্তক্ষরণ হয়।
৩. রক্ত মিশ্রিত পাতলা মলত্যাগ করে।
৪. শ্বাস কষ্ট, মুখে দুর্গন্ধ, নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
৫. চোখ নাক মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
৬. কণ্ঠনালি ও পরিপাক নালিতে প্রদাহ ও রক্তক্ষরণ ঘটে।
৭. আক্রান্ত বেশি হলে নিউমোনিয়া হয়।
৮. ছাগল দুর্বল হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।
৯. দেহে কাঁপুনি উঠে।
প্রতিরোধ : ১. পিপিআর রোগের টিকা দিতে হবে।
২. সুস্থ ও অসুস্থ ছাগল পৃথক রাখতে হবে।
৩. রোগাক্রান্ত মৃত ছাগল মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
৪. স্বাস্থ্যসম্মত লালন পালন ব্যবস্থা করতে হয়।
প্রতিকার : চিকিৎসা নেই।

জলাতঙ্ক
ভাইরাস সংক্রামক রোগ। স্তন্যপায়ী সব প্রাণীর এ রোগ হয়। কুকুর, শিয়াল, হায়না এ রোগজীবাণুর প্রধান বাহক। আক্রান্ত প্রাণীর কামড়ের মাধ্যমে সুস্থ প্রাণীর দেহে রোগজীবাণু সংক্রামিত হয়ে রোগ সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ রোগ আক্রান্ত কুকুরের কামড়ে হয়ে থাকে। সাধারণত কামড়ের ৭-১০ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
লক্ষণ : ১. আক্রান্ত পশু পাগলের মতো ছুটাছুটি করে।
২. যা কিছু সামনে পায় তাই কামড়াতে চেষ্টা করে।
৩. চোখ লাল বর্ণ দেখায়।
৪. মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরে।
৫. কণ্ঠের অবশতার জন্য পানি গিলতে পারে না। খাদ্য গিলতে পারে না।
৬. পক্ষাঘাত হয়ে পশু মারা যায়।
৭. নিস্তেজ বা বোবা অবস্থায় আক্রান্ত পশুর চোয়ালে অবশতা দেখা দেয়। জিহবা বের হয়ে ঝুলে পড়ে।
৮. পশু চুপচাপ নির্জন স্থানে শুয়ে থাকে। পক্ষাঘাতের জন্য পেছনের পা হেঁচড়িয়ে চলে।
৯. লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৪/৫ দিনের মধ্যে পশু মারা যায়।
রোগ প্রতিরোধ : ১. জলাতঙ্ক রোগের প্রতিরোধক টিকা দেওয়া।
২. আক্রান্ত পশুর কামড়ানোর স্থান সাথে সাথে সাবান ও পানি দিয়ে খুব ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে যাতে আক্রান্ত প্রাণীর লালা বা রোগ জীবাণু ধুয়ে চলে যায়।
৩. ক্ষতস্থান ধোয়ার পর সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক টিকা দিয়ে দিতে হবে।
৪. আক্রান্ত স্থানে ক্ষত হলে ক্ষতের চিকিৎসা করাতে হবে।
৫. রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর মেরে ফেলতে হবে।
৬. পোষা কুকুর রেজিস্ট্রেশন করে প্রতিষেধক টিকা দিয়ে দিতে হবে।

লেখক: কৃষি প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, কৃষিশিক্ষা, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত লেখক।

Exit mobile version