কৃষিসংবাদ

গ্রীষ্মকালীন সয়াবিনের নানা জাত ও চাষাবাদের কলা কৌশল পদ্ধতি

গ্রীষ্মকালীন সয়াবিনের নানা জাত

ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল

গ্রীষ্মকালীন সয়াবিনের নানা জাত

সয়াবিন বিশ্বের অন্যতম প্রধান তৈলবীজ ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে যা সয়াবিন উৎপাদিত হয় তা চাহিদার এক পঞ্চমাংশ মাত্র। এ চাহিদাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের বিজ্ঞানীগণের উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসাবে সয়াবিনের কতকগুলো জাত উদ্ভাবন করেছেন যা প্রচলিত জাত থেকে ফলন বেশি দেয় এবং জীবনকাল কালও কম।

সয়াবিনের জাতসমূহঃ বিনা সয়াবিন-২, বিনা সয়াবিন-৫, সোহাগ, বারি সয়াবিন-৫ এবং বারি সয়াবনি-৬

মাটি ও আবহাওয়া: বেলে দো-আঁশ, দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে সয়াবীন চাষ করা যায়। খরিফ মৌসুমের জন্য উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য জমি নির্বাচন করতে হবে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা ও যশোহর অঞ্চল সয়াবিন চাষের জন্য উপযোগী এলাকা।

জমি তৈরি: মাটির প্রকারভেদে ৩-৪ টি চাষ ও আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে পরবর্তীতে জমিতে পানি নিষ্কাশন ও অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যার সুবিধা হয়।

বপনের সময়: খরিফ মৌসুমে মধ্য আষাঢ় থকেে শ্রাবন এবং ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি (জুলাইয়ের প্রথম থেকে আগষ্টের শেষ) পর্যন্ত। উল্লেখিত সময়ের আগে বপন করলে ফুল আসতে কিছুটা বিলম্ব হয় বিধায় ফসলের আয়ুষ্কাল দীর্ঘায়িত হয়।

বীজের হার: সারিতে বপনের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ১৯-২২ কেজি এবং ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ২২-২৬ কেজি। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দুরত্ব ৩০ সেঃমিঃ দিতে হবে। বপনের পূর্বে ছত্রাকনাশক প্রোভেক্স দ্বারা বীজ শোধন করে নিলে ভালো।

সারের মাত্রা: জমির উর্বরতা সব জায়গায় সমান নয়। তাই কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয়। সয়াবীন চাষের জন্য সাধারণভাবে অনুমোদিত সারের মাত্রা হলঃ প্রতি একরে (কেজি) ইউরিয়া ২০-২৫, টিএসপি ৬০-৭০, এমপি ৩৫-৪০, জিপসাম ৩৫-৪৫ এবং জীবাণুসার (ইউরিয়া সারের পরিবর্তে) প্রতি কেজি বীজে ২০-৩০ গ্রাম।

জীবাণুসার প্রয়োগ ও ব্যবহার পদ্ধতি: এক কেজি ভিজা সয়াবীন বীজের মধ্যে ২০-৩০ গ্রাম জীবাণুসার ছিটিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে বীজের গায়ে সমভাবে মিশে যায়। জীবাণুসার মিশানোর পর বীজ বেশি সময় রোদে ফেলে রাখলে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই তাড়াতাড়ি বীজ বপন করতে হবে।

আন্ত:পরিচর্যা: চারা গজানোর ২০-২৫ দিনের মধ্যে আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে, জাতভেদে সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব রাখতে হবে ৩.০-৪.০ ইঞ্চি। তবে প্রতি বর্গ মিটারে খরিফ মৌসুমে ৪০-৫০টি গাছ রাখা উত্তম।
পোকামাকড়: বিছাপোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা এবং কাটুই পোকা সয়াবীনের মারাত্মক ক্ষতি করে। বিছাপোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা ডিম থেকে ফোটার পর ছোট অবস্থায় পোকাগুলো একস্থানে দলবদ্ধভাবে থাকে এবং পরবর্তীতে আক্রান্ত গাছের পাতা খেয়ে জালের মতো ঝাঁঝরা করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য আক্রান্তপাতা দেখে পোকাসহ পাতা তুলে পোকা মেরে ফেলতে হবে। প্রতি বঘিায় ৮-১২টি গাছরে ডাল বা কঞ্চি পুঁতে দলিে পোকাভোজী পাখি কীড়া খেয়ে দমন করতে পারে। আক্রমণ খুব বেশি হলে রিপকর্ড ১০ ইসি বা পারফেকথিয়ন ৪০ ইসি ২০ মিলি (৪মুখা) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষেতে ১০ দিন অন্তর ২ বার স্প্রে করে ও পোকা দমন করা যায়।

রোগবালাই দমন: হলুদ মোজাইক ভাইরাস ও কান্ড পঁচা রোগ সয়াবী্নের প্রধান রোগ। সয়াবীনের সবুজ পত্রফলকের উপরিভাগে উজ্জ্বল সোনালী বা হলুদ রঙের চক্রাকার দাগের উপস্থিতি হলুদ মোজাইক ভাইরাস রোগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তবে সুস্থ এবং রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ অনেকটা কমানো যায়। হলুদ মোজাইক ভাইরাস গাছ দেখার সংগে সংগে গাছটি উপড়ে ফেলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাকের কারণে কান্ড পঁচা রোগ হয়ে থাকে। গাছের পাতা হলুদ হওয়া দেখেই এ রোগের আক্রমণ সনাক্ত করা যায়। আক্রান্ত গাছের কান্ড এবং মূলে কালো দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরে যায়। গভীর চাষ এবং জমি হতে ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলে এ রোগের উৎস নষ্ট করা যায়। অথবা জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে ও এ রোগ দমন করা যায়।

ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ: ফসল পরিপক্ক হলে গাছগুলো শুঁটিসহ হলুদ হয়ে আসে। এ সময় সয়াবীন গাছ মাটির উপর হতে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দানাগুলো আলাদা করতে হবে। মাড়াই করা বীজ রোদে ভালো করে শুকিয়ে ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হবে। সয়াবীনের অংকুরোদগম ক্ষমতা সাধারণ অবস্থায় বেশি দিন বজায় থাকে না। দুই থেকে তিন মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই পরবর্তী মৌসুমে লাগানোর জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবেঃ
১. বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে।
২. পলিথিনের ব্যাগ, টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসীতে বীজ সংরক্ষণ করে মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভিতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠাণ্ডা হলে সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. বীজের পাত্র অবশ্যই ঠান্ডা অথচ শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। সরাসসি মেঝেতে না রেখে মাচা বা কাঠের তক্তার উপর রাখলে ভালো হয়।
৪. মাঝে মধ্যে বীজের আর্দ্রতার দিকে নজর রাখতে হবে। বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে প্রয়োজনমতো রোদে শুকিয়ে পূর্বের ন্যায় একই নিয়মে পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।

======================================================
*প্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ

Exit mobile version