কৃষিসংবাদ

দুগ্ধ ও মাংস শিল্প লোকসানের অন্যতম কারন ভাল জেনেটিক্স না পাওয়া

গাভীর জাত উন্নয়নে

শাহ এমরান

মাংস শিল্প লোকসান ঃ বাংলাদেশের দুগ্ধ ও মাংস শিল্প লোকসান করার অন্যতম একটি কারন ভাল জেনেটিক্স না পাওয়া। সরকারী ফলপ্রসু কোন উদ্যোগ নেই, প্রাইভেট কোম্পানীর হাত-পা বাধা সরকারী পলিসিতে। যুক্তরাষ্ট্রে একটি গাভীর সর্বনিন্ম গড় দুধ প্রদানের ক্ষমতা ৪২.৬২ লিটার, অস্ট্রেলিয়াতে গড় ৩৯.৩৪ লিটার, ভারতে গড় ২৬.২২ লিটার, পাকিস্তানে গড় ২৯.৩৮ লিটার, শ্রীলংকাতে গড় ২৬.৬৭ লিটার। অর্থাৎ ৩০৫ দিনে একটি গাভী যে দুধ প্রদান করে মোট উৎপাদনকে ৩০৫ দিয়ে ভাগ করে এই গড় উৎপাদন বের করা হয়েছে যা আন্তর্জাতিকভাবে রেকর্ডেড। বাংলাদেশে কত? প্রশ্নটা নিজের কাছে করতে লজ্জাবোধ হয়। বাংলাদেশে এভারেজ গরু প্রতি দুধ প্রোডাকশন ৬ থেকে ৭ লিটার। বাংলাদেশের একজন কৃষক কখন লোকসান করবেনা যদি তার কাছে একটি ২০ লিটার দুধ দেয়া সম্পন্ন গাভী থাকে। এই মন্তব্য পড়ে যদি কোন সরকারী কর্মকর্তা ভাবে ভালো উন্নত জাত খামারিরা পারবেনা মেইন্টেন করতে, তাদের জন্য ১০-১২ লিটার দুধের গাভী ঠিক আছে ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে আমরা বলবো এসব চিন্তা করা আপনারা বাদ দিন।

ব্যবসাতে লাভ আসলে খামারি খুব ভাল জানে কোথায় কিভাবে রাখতে হবে কারন সে এই গরু দিয়ে ব্যবসা করে। নিজের জীবনের থেকে বেশী সমাদর করবে যদি ব্যবসা হয়। ৬/৭ লিটার দুধ দেয়া সম্পন্ন গাভীকে লালন পালন করতে যে খরচ, শ্রম, ঝুকি ও সময়ের মূল্য হিসাব করলে বর্তমান বাজারে কৃষকের লোকসান। অথচ এই একই শ্রম, কাছাকাছি খরচ ও ঝুকিতে কৃষক যদি গড় ২০ লিটার দুধ দেয়া সম্পন্ন গাভী তৈরী করতে পারতো সেই কৃষক বর্তমান দুধের বাজার দরেও কখন লোকসান করতোনা এবং দেশ ও দুধ ও মাংস শিল্পে সমৃদ্ধি পেতো। অন্যদিকে মাংসের জন্য একটি দেশী গরুর দৈনিক বৃদ্ধি ১৫০ গ্রাম থেকে ২০০ গ্রাম। উন্নতজাতের ব্রাহমা ও শাহীওয়ালের গ্রোথ আসে ১ থেকে দেড় কেজি প্রতিদিন। সরকার বিদেশ থেকে আমদানী করে কেন এই উন্নত সিমেন এনে এভাইলেবল করছেনা খামারিদের জন্য? কেন সরকার নিজে করছেনা এবং প্রাইভেটকেও করতে দিচ্ছেনা? কেন আমাদেরকে দেশেই তৈরী নিম্নমানের আজে বাজে সিমেন দিয়ে ক্রস তৈরী করতে হবে? কোথায় বাধা? আমরা কেন পারিনি এতদিনে? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে যে উত্তরগুলো আসবে তা সুখকর হবেনা সবার জন্য।

বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ পাট শিল্প, বিদ্যুৎ সহ যত প্রতিষ্ঠান আছে সব লোকসান করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে তার কারন এই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চায় দুর্নীতিকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেবার জন্য। তারা নিজেরা উন্নতি করবেনা এবং সকল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে করতে দেবেনা। সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মানসিকতা হলো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সবাই চোর, তাদেরকে নানারকম জটিলতায় আটকে রেখে দিতে হবে এবং কাজ করবে শুধু সরকার। এই ধরনের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না আসে দেশের দুগ্ধ ও মাংস শিল্পের পরিবর্তন কোনদিন আসবেনা। এদেশে সৎ ও পরিশ্রমের সাথে কেউ ব্যবসা করতে চাইলেও সরকারী নানারকম জটিলতার কারনে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো পারেনা। অথচ চোরাইপথে কোন জিনিসটা না আসে এদেশে? এদেশে উন্নত জাতের যেসকল গরু, ছাগল, ভেড়া পাওয়া যায় তার অধিকাংশই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা। ভারতের ওপার থেকে দেদারসে ঢুকছে ফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, ব্রাহমা সিমেন। কে পেরেছে আটকাতে?অথচ কোন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বা খামারি যদি যায় নিজের খামারের জন্য উন্নত জাতের গরু ও উন্নত মানের সিমেন আমদানী করতে, আপনাকে পারমিশন দেয়া হবেনা। ফলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চড়া দামে গরু ও সিমেন বিক্রি করে দেশের খামারিদের ঠকাচ্ছে।

বিগত ৭ বছরে এই দেশে দুগ্ধ ও মাংস শিল্পে যা উন্নতি হয়েছে আমি বলবো এটা সম্ভব হয়েছে দেশের তরুন লেখাপড়া জানা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং জিওলজিক্যাল পলিটিক্যাল কিছু সুবিধা ও দেশের প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের কারনে। কোন সরকার এখন পর্যন্ত কোন সুবিধা খামারিদের কাছে তুলে দিতে পারেনি। সরকার কি পেরেছে খামারিদের বিদ্যুৎ, পানির বিল কৃষির আওতায় আনতে, সরকার কি পেরেছে খামারদের জমির খাজনা বানিজ্যিক না করে কৃষির আওতায় আনতে, পেরেছে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন ও ভালো সিমেন সরবারহ বা ডাক্তারী সেবা ও পশুখাদ্যের সিন্ডিকেট রুখতে বিগত ৭ বছরে? যা উন্নয়ন হবার তা করেছে দেশের খামারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের উদ্যোগে। মোদী সরকারের গরু আসা বন্ধ করা এদেশের জন্য সাপে বর হয়েছে। দেশে মাংসের ঘটতি তৈরী হয়েছে ফলে দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে এবং হাজারো তরুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছে। এরপরেও আমরা দেশের সকল উন্নয়নের অংশীদার হিসাবে সবাইকে পেতে চাই একত্রে। সরকারী পলিসি হতে হবে খামারি বান্ধব। সরকার ঠিক করে দেবেনা একজন খামারি দুগ্ধ খামারের ব্যবসা করবে নাকি গরু মোটাতাজাকরন ব্যবসা করবে।

দেশের ব্ল্যাক বেংগল ছাগলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে, দেশী গরুর ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই প্রজেক্ট আপনি পারেন না চাপিয়ে দিতে খামারিদের উপরে। সেটা সরকারী খরচে সরকারের করতে হবে এবং খামারিরা তখনই উদ্যোগী হবে যখন এই ব্রিডগুলো নিয়ে ব্যবসা করে লাভ করবে। পুরো পৃথিবী চলছে একদিকে, আর আমরা চলছি উল্টো পথে! যে যেই ব্যবসা করতে চায় তাকে বৈধতার মধ্যে ফুল সাপোর্ট দিতে হবে। খামারি লোকসান করবে এমন জাত মানের পলিসি কোনদিন কাজে আসবেনা এবং এ দেশের দুগ্ধ ও মাংস শিল্পের খামারিরা তা আর অবশ্যই মেনেও নেবেনা এবং প্রয়োজনে শিঘ্রই আন্দোলনে যাবে।

লেখকঃ মহাসচিব, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন

Exit mobile version