কৃষিসংবাদ

দেশি মাগুরের চাষে বছরে অর্ধকোটি টাকা আয় করা সম্ভব

আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি থেকে:মাগুর চাষ

মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ ছাড়া আমাদের এক দিনও কি চলে! বাংলাদেশে শিং-মাগুর অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছ। বাজারে এ মাছের কদর অনেক বেশি। এ কারণেরই এটি দামি ও বহুল আলোচিত ও সমাদৃত। রোগীদের পথ্য হিসাবে শিং-মাগুরের ব্যাপক চাহিদা ও জিইয়ে রাখার মত এ মাছ। বাড়িতে যে কোন পাত্রে অনেক দিন পর্যন্ত জীবিত রাখা সম্ভব। বর্তমানে চাষের অভাবে এবং পানিতে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ ও কেমিকেল নদীতে পড়ায় এ মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশি শিং ও মাগুর চাষ ব্যাপক আকারে হচ্ছে। আশা করবো দিন দিন এ মাছের চাষ বাড়বে এবং দেশের শিক্ষিত বেকার ভাই ও বোনেরা মিনি পুকুরে এ মাছের চাষ করে বেকারত্ব ও দারিদ্র দূর করবে। শিং-মাগুর মাছ অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। অধিক সংখ্যক মাছ এক সঙ্গে চাষ করা যায়। স্বল্প গভীর পানিতে নিরাপদে চাষ করা সম্ভব। অন্যান্য মাছের তুলনায় এ মাছের চাহিদা ও বাজার মূল্য অনেক বেশি। অতিরিক্ত শ্বাসনালী থাকায় বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে এরা বেঁচে থাকতে পারে। যার জন্য এ মাছ জীবন্ত বাজার জাত করা সম্ভব। কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব।
অতিরিক্ত শ্বাসনালী থাকায় পানি ছাড়াও বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। তাই মজা ও পঁচা পুকুর, ছোট ছোট ডোবা ইত্যাদি জলাশয়ের দূষিত পানিতেও মাগুর মাছের বেঁচে থাকতে কোনো সমস্যা হয় না। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে যে প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়, সে অবস্খায়ও ছোট ছোট গর্ত করে এ মাছ দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। পানি থেকে উত্তোলনের পর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কারণে জীবন্ত মাগুর বাজারজাত করা সম্ভব।

পুকুর নির্মাণ: পুকুরের আয়তন ১০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশ এবং গভীরতা ৮০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার (৩ থেকে ৪ ফুট) হওয়া বাঞ্ছনীয়। অধিক গভীরতা উৎপাদনের দিক থেকে অসুবিধাজনক। কেননা, মাগুর মাছকে শ্বাস নেয়ার জন্য সবসময় উপরে আসতে হয়। এতে অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয়ের কারণে মাছের বৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট বিঘল্প ঘটে।

পুকুর তৈরি: পাড়ের ঊর্ধ্বসীমা অবশ্যই সর্বোচ্চ বন্যার লেভেল থেকে ৩০ সেন্টিমিটার (১ ফুট) উপরে রাখা আবশ্যক। এতে বৃষ্টির সময় মাছ বুকে হেঁটে বাইরে যেতে পারবে না। তদুপরি বাইরে থেকে সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি মৎস্যভুক প্রাণীও পুকুরে প্রবেশের কোনো সুযোগ পাবে না। এ ছাড়া পুকুরের চারদিকের পাড়ের উপর ৩০ সেন্টিমিটার উঁচু নেটের বেড়া দেয়া বাঞ্ছনীয়।

চুন প্রয়োগ: পুকুরের তলদেশ শুকিয়ে হালকাভাবে চাষ দিয়ে তলার মাটির অম্ল বা খরতা পরীক্ষা সাপেক্ষে প্রতি শতাংশে ১ থেকে ১.৫ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের পর পুকুর ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি) পরিমাণ পানি ঢুকিয়ে সপ্তাহখানেক ধরে রাখতে হবে।

জৈব সার প্রয়োগ: চুন প্রয়োগের ৭ থেকে ১৫ দিন পর প্রতি শতাংশে ১০ কেজি হারে গোবর সার অথবা ৫ কেজি হারে মুরগির বিষ্ঠা ছিটিয়ে দিতে হবে।

অজৈব সার প্রয়োগ: জৈব সার প্রয়োগের সাত দিন পর পানির উচ্চতা ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বজায় থাকা অবস্খায় প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম এমওপি সার ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পানির রঙ বাদামি সবুজ, লালচে বাদামি, হালকা সবুজ, লালচে সবুজ অথবা সবুজ থাকাকালীন অজৈব সার (রাসায়নিক) প্রয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই।

পোনা মজুদ: ৫ থেকে ৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যরে সুস্থ্য সবল পোনা প্রতি বর্গমিটারে ৫০ থেকে ৮০টি হারে পুকুরে ছাড়া যেতে পারে। মে থেকে জুন মাস মাগুরের পোনা ছাড়ার যথার্থ সময়।

মাগুরের খাদ্য ব্যবস্থাপনা: প্রাাকৃতিক পরিবেশে মাগুর মূলত জলাশয়ের তলদেশের খাদ্য খেয়ে জীবনধারণ করে। প্রাকৃতিক এই খাদ্যগুলো হচ্ছে- জলাশয়ের তলার আমিষ জাতীয় পঁচনশীল দ্রব্যাদি, প্রাণী প্লাঙ্কটন ও কেঁচো জাতীয় ক্ষুদ্রাকার প্রাণী ইত্যাদি।

সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ: অধিক ঘনত্বে চাষের ক্ষেত্রে পুকুরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ অপরিহার্য। সহজলভ্য দেশীয় উপকরণ সমন্বয়ে মাগুর মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রস্তুত করা যায়। এ ক্ষেত্রে চালের কুঁড়া ৪০ শতাংশ, তৈলবীজের খৈল ৩০ শতাংশ এবং শুঁটকি ৩০ শতাংশ একত্রে মিশিয়ে গোলাকার বল তৈরি করে মাছকে সরবরাহ করা যেতে পারে। তা ছাড়া শামুক ও ঝিনুকের মাংস মাগুরের অত্যন্ত প্রিয় খাবার। এগুলোও অবাধে খাওয়ানো যায়।

খাদ্যের প্রয়োগমাত্রা: পুকুরে মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে দৈনিক খাদ্যের এক-চতুর্থাংশ সকালে এবং বাকি তিন-চতুর্থাংশ সন্ধ্যায় প্রয়োগ করতে হবে। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উপরোক্ত প্রযুক্তি মোতাবেক পুকুরে চাষকৃত দেশী মাগুরের ওজন অনধিক ৪ থেকে ৫ মাসে ১৭৫ থেকে ২০০ গ্রামে উন্নীত করা সম্ভব।
একজন সফল মৎস্য খামারীর বাস্তব তথ্য অনুযায়ী কোন পুকুরে ১ লক্ষ পোনা মাছ চাষ করলে নিম্নতম ৮৫ হাজার মাগুর টিকে থাকবে। ৬ মাসে পরে মাগুর মাছের ওজন (প্রতিটি মাছের উজন গড়ে ১৭৫ গ্রাম হলে) ১৪৮৭৫ কেজি। বর্তমান বাজার দর প্রতি কেজি মাগুর পাইকারি বিক্রয় মূল্য ৪৫০ টাকা হিসাবে ১৪৮৭৫ কেজির দাম হবে ৬৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকা। এদিকে ১ লক্ষ পোনা মাছের ৬ মাসের খাদ্য খরচ সর্বোচ্চ ১৫ টন খাবার প্রয়োজন হবে। খাবারের বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি টন খাবারের দাম ৫০ হাজার টাকা। এ হিসাবে ৮ টন খাবারের দাম পড়ে ৮ লক্ষ টাকা এবং শ্রমিক ও পরিবহন খরচ হবে দেড় থেকে ২ লক্ষ টাকা। সমস্ত খরচ বাদে বছরে কমপক্ষে ৫০ লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব।

শেষ কথা:
মাগুর বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় মাছের মধ্যে অন্যতম। সুস্বাদু ও উপাদেয় এ মাছ দেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। রোগীর পথ্য হিসেবেও এ মাছের জনপ্রিয়তা রয়েছে। এক সময় এই মাছটিকে সহজেই প্রাকৃতিক জলাশয়ে পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দেশি মাগুর আর তেমন পাওয়া যায় না। তাই মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। তবে আশার কথা হল দেশের মাছ চাষিরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই মাছটিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আর এই সুস্বাদু মাছটিকে লাভজনক একটি করতে হলে সঠিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা ও সুষ্ঠুভাবে চাষ করার কোন বিকল্প নেই।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version