কৃষিসংবাদ

নগর কৃষিঃ খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্যই প্রয়োজন

city agriculture
কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায়
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান মতে বর্তমান বিশ্বে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি লোক নগরে বসবাস করে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯০০ কোটি। তখন ৮০% অর্থাৎ ৭২০ কোটি লোক নগরে বসবাস করবে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সারা বিশ্বে সৃষ্টি হবে এক ভয়াবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, শিল্প -কারখানা , অফিস-আদালত নির্মাণের ফলে জলাভূমি ও আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাবে ব্যাপকভাবে। খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে ও সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আবাসন, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও কর্মসংস্থানসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উঠবে নগর জীবন। বিদ্যমান খাদ্যাভাস ও উৎপাদন ব্যবস্থা বজায় রেখে পৃথিবীর চাষযোগ্য জমির উৎপাদিত খাদ্য দিয়ে ভবিষ্যতে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
বর্তমানে পৃথিবীর কমপক্ষে ৮০ কোটি লোক কোনো না কোনো নগরীয় খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত । ফলে নগর ও তার আশ-পাশে ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ, পশু-পাখি পালন ও প্রক্রিয়াজাত করণের কাজ আগের তুলনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এউদ্দেশ্যে গত বছর ২৯ ,৩০ ও ৩১ জানুয়ারি সুইডেনের লিংকোপিং-এ অনুষ্ঠিত হলো নগর কৃষি সম্মেলন-২০১৩। এটি ছিল পৃথিবীতে নগরীয় কৃষির ওপর সবচেয়ে বড় সম্মেলন। এ সম্মেলনে চীন, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকগণ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে নগরবাসীর খাদ্য সমস্যা সমাধানে নগরীয় পরিবেশে ভার্টিকেল গ্রীন হাউজ তৈরীর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এতে কম খরচে, বিনা পরিবহন ব্যয়ে খাদ্যশস্য, টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল নগরবাসীর কাছে সরারসরি পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত প্রকাশ করেন। এবারের সম্মেলনে বলা হয়, ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এখন থেকে আমাদের উপযুক্ত কর্মপন্থা বের করতে হবে। কারণ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য নগরীয় কৃষি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কর্মসূচিতে নগরীয় কৃষিকে অর্š—ভুক্ত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী নগরীয় কৃষি বিষয়ক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পেশাজীবী বোর্ড গঠন করে নগরীয় কৃষি বিষয়ে জাতিসংঘকে কারিগরী সহায়তা প্রদান করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নগরীয় কৃষি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদান করতে হবে। আমাদের দেশের জনগণ কোনো না কোনো স্থানীয় ইউনিটে (ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) বসবাস করছে। সেজন্য স্থানীয় সরকারগুলোতে এখন থেকেই নগরীয় কৃষি বিষয়ে সম্যক ধারণা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধানের সঙ্গে নগরের মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে নগরকৃষি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভার ব্যবস্থা করতে হবে। নগর ও তার আশে-পাশে স্থানীয় ভাবে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিতে হবে। নগরীয় কৃষির প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের জন্য দরকার হলে নগর কর কাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে। নগরীয় কৃষি বিষয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে উপযুক্ত শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নগরায়ণের সাথে সাথে বাড়ছে নগরীয় কৃষি কর্মকাণ্ড। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের নগরগুলিতে বর্তমানে ৫ লাখেরও বেশি কৃষি খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, মুরগীর বাচ্চা, মাছের পোনা ও টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উন্নত মানের চারা উৎপাদন হচ্ছে। ঢাকা নগরে বর্তমানে বহু ডেইরি ফার্ম আছে। ছাদে ও বসতবাড়িতে ৫০ হাজারের মতো সবজি ও ফল বাগান রয়েছে। ছাদে বাগান তৈরী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে নগর থেকে নগরে । রাজশাহী নগরীতে উন্নত মানের ভাইরাসমুক্ত আলুবীজ, ফুল ও ফলের চারা উৎপাদনের জন্য প্রায় ২০ টির অধিক টিস্যু কালচার ল্যাব স্থাপিত হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে নগরীয় কৃষির এ সংস্কৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং সমাজ জীবনে এক নতুন প্রযুক্তির বার্তা বয়ে আনছে। নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জন্য নগরীয় এলাকায় শাকসবজি উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরীয় কৃষির এ অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে হলে নগর এলাকায় মান সম্পন্ন বীজ, জৈবসার, জৈব বালাই নাশক, মাছের পোনা, হাঁস-মুরগীর বাচ্চা, পোল্ট্রি ফিড, মাছের খাবার, পশুখাদ্য এবং আধুনিক প্রযুক্তির সরবরাহ বাড়াতে হবে। উদ্যোগক্তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো এসব কাজ করার জন্য নিকটবর্তী স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আছে কি না ? বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২৪টি নগরে প্রায় ৫ কোটি লোক বসবাস করছে। ২০২০ সাল নাগাদ দেশের ৫০% অর্থাৎ সাড়ে আট কোটি লোক নগরে বসবাস করবে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গোটা জনগোষ্ঠী নগরে বসবাস করবে। তখন গ্রামগুলো বর্তমানের আদলে থাকবে না। সেখানেও নগরীয় সুযোগ সুবিধা পৌঁছে যাবে। বর্তমান ব্যবস্থায় নগরে বসবাসকারী ৫ কোটি লোককে কৃষি কর্মকান্ডের বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থা বহাল থাকলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও উৎপাদন ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। গ্রামীণ কৃষি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য দেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর সহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে সঙ্গে রয়েছে হাজার হাজার কৃষিবিদ ও ডিপ্লোমা কৃষিবিদ। তাদের কর্মকাণ্ড গ্রামকেন্দ্রিক। আমার জানা মতে ঢাকা নগরে ৪টি, চট্টগ্রাম নগরে ২টি , রাজশাহীনগরে ১টিও খুলনা নগরে ১টি সহ দেশে মাত্র ৮ জন মেট্রেপিলিটান কৃষি কর্মকর্তা ও তাঁদের অধীন সামান্য সংখ্যক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রযেছেন। তাঁরা খুব সীমিত পরিসরে নগরীয় এলাকায় কৃষি সেবা প্রদান করছেন। বাংলাদেশের ৩২৪টি নগরে ৩ লাখ পরিবার আছে। কৃষির কোনো না কোনো কর্মকান্ডের সাথে তারা যুক্ত রয়েছে। বাড়ির ছাদে শাক- সবজি, ফল-মূলের চাষ, বসতবাড়িতে গরু- ছাগল, কুয়েল, কবুতর, হাঁস- মুরগী ও খরগোশ পালন এবং মাশরুম চাষ করে অনেকে পারিবারিক প্রয়োজন মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। হাইড্রোপনিক-এর মাধ্যমে বসতবাড়িতে মাটি ছাড়া সবজি,ফল ও ফুল চাষের আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞনীগণ। নতুন প্রযুক্তি; অ্যাকুয়াপনিকস এর মাধ্যমে বসতবাড়িতে, ছাদে ও বারান্দায় একই সাথে মাছ ও সবজি চাষের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে ইতোমধ্যে। এসব প্রযুক্তিকে আরও সম্প্রসারণ ও উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি নগরে ‘নগর সরকার’ ব্যবস্থা। তার আগে প্রস্তাবিত দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পদ্ধতি মেনে নেওয়া যৌক্তিক হবে বলে বিশ্বাস করি। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ ও নগর আদালত মিলে নগর সরকার গঠন করা যেতে পারে। নগরীয় এলাকায় উপসহকারী কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ কর্মকর্তা সহ কৃষি বিষয়ক অন্যান্য কর্মকর্তাগণ নগর প্রশাসনের অধীনে থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। তখন নগরীয় কৃষি বিষয়ক চিন্তাটি নগরবাসীর হয়ে পড়বে এবং নগরীয় কৃষি বিষয়ক কর্মকাণ্ড নিকটবর্তী কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হবে। এর জন্য প্রযোজন উপযুক্ত নীতি নির্ধারন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দারিদ্র বিমোচন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নে নগরীয় কৃষি কর্মকাণ্ড আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশগত দিক থেকেও নগরীয় কৃষি অনেক সুফল বয়ে আনবে। নগরীয় কৃষির যত সম্প্রসারণ ঘটবে নগরে ততই কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ও তাপমাত্রা হ্রাস পাবে। হ্রাস পাবে শব্দ ও বায়ু দূষণ। বাড়বে বৃষ্টিপাত। উন্নত হবে নগরের পরিবেশ। বিগত দুই শতক ধরে পৃথিবীর বহু ধনী ও দরিদ্র দেশে নগরীয় কৃষি কার্যক্রম ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরীয় কৃষি কর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন ও উত্তর আমেরিকার লাখ লাখ নগরবাসী তাদের বাড়ি ভিটায়, বহুতল বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, রাস্তার পাশে, নগরের অব্যবহৃত খালি জায়গায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদন, ও প্রাণী পালন শুরু করেছেন। আমেরিকা, ভারত, চীন ও কিউবাতে নগরীয কৃষি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে প্রতি বছর প্রায় ১% হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১.৫% হারে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমিতে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে নগর পকিল্পনায় কৃষিকে অর্š—ভুক্ত করে গ্রামীন কৃষির পাশাপাশি নগরের প্রতি ইঞ্চি অব্যবহৃত জমিতে নগরীয় কৃষি কর্মকাণ্ড শুরু করার পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। নগরে শুধু রাজকর্মচারী, সৈনিক, ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়সহ অকৃষি পেশার লোক বাস করবে, নগর হবে ইট পাথরের জঞ্জাল, থাকবে না কোনো সবুজ বৃক্ষ , সুশীতল ছায়া, স্বচ্ছ জলাশয় , যানবাহন, মিল-কারখানার কালো ধোয়া ও শিল্প বর্জ্যে বিষাক্ত হবে মাটি, পানি ও বাতাস- নগর নীতিমালার এ সনাতন ধারণা আমাদের অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। বিদেশের মতো করে নয়, আমাদের দেশের মাটি, জলবাযু, নগরের অবস্থান, জনসংখ্যা, মানুষের সংস্কৃতি, চাহিদা, খাদ্যাভাস প্রভৃতির সাথে সংগতি রেখে দেশে প্রতিটি নগরে গড়ে তুলতে হবে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও কৃষিবিদসহ সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। বিল্ডিং কোড-এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে ভবিষ্যতে যেসব স্থাপনা তৈরী হবে সে গুলোকে নগরীয় কৃষির উপযোগী করে নির্মাণ করতে হবে । বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপনের ব্যবস্থা রেখে পরিকল্পিত সবুজ আবাসন এবং সবুজ নগর গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে বসবাসকারীদের চিন্তা করতে হবে কিভাবে তাদের ইউনিটটি পরিবেশ বান্ধব পরিকল্পিত করা যায়। সেজন্য নগর সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে উক্ত চিন্তাটি নগরবাসীর হাতে ছেড়ে দিতে হবে।

কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম

Exit mobile version