কৃষিসংবাদ

খাটো জাতের নারিকেলের বাম্পার ফলন পেতে করণীয়

নারকেল চাষ

কৃষিবিদ ড. এম এ মজিদ মন্ডল
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া নারিকেলের উৎপত্তিস্থল বলে ধরা হয়। বর্তমানে নারিকেল উৎপাদনকারী দেশ সমুহের মধ্যে ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, ওয়েষ্ট ইণ্ডিজ, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, জ্যামাইকা, পানামা, বাংলাদেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যে সব দেশ সমুদ্্েরর উপকুল বিদ্যামান সে সব দেশে নারিকেল ভাল হয়। নারিকেল গাছের বহুবিদ ব্যাবহারের জন্য একে কল্প বৃক্ষ ( স্বগীয় গাছ) বলা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে কম বেশী নারিকেলের হয় তবে উপকুলাঞ্চে বেশী ভাল হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে নারিকেল চাষ হয় যার উৎপাদন প্রায় ১ লক্ষ মেট্টিক টন। বাংলাদেশে কৃষক তিনটি কারণে নারিকেলের ভাল ফলন পায় না যথা ঃ (অ) প্রাকৃতিক কারন (যেমন- মাটি ও জলবায়ু সমস্যা, জেনেটিকেলি সমস্যা,ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি), (আ) রোগ ও (ই) পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্চা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষতি প্রায় স¤পূর্ণ রুপে সমাধান করা সম্ভব। নীচে ইহা কৃষক ও কৃষি শিক্ষা বিষয়ের জন্য পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল ঃ-

ফল না ধরা ও ঝরে পড়ার কারণসমুহ ঃ
১ গাছে পুষ্টি উপাদানের অভাব হলে ফল কম ধরে বা ঝরে পড়ে, (২) কৌলিক গঠন, (৩) গর্ভমুন্ডে নিম্ন পরাগহীনতা, (৪) বর্ধিত ভ্রণের পুষ্টিহীনতা, (৫) একই ছড়ায় অনেক গুলি ফল ধারন, (৬) নির্মোচন স্তর গঠন ( মাটিতে রসের অভাব বা আধিক্য ঘটলে ফল ও পএ বৃন্তের সংযোগস্থলে নির্মোচন স্তর গঠিত হয়ে ফল ঝরে পড়ে), (৭) প্রবল ঝড়, (৮) শিলাবৃষ্টি, (৯) দীঘ সময় খরা, (১০) মাটিতে রসের অভাব, (১১) হরমোনের অসাম্যতা, (১২) এুটি পূর্ণ ছাটাই করণ, (১৩) বন্ধা নারিকেল উৎপাদন, (১৪) রোগ ও (১৫) পোকা-মাকড়ের অক্রমণ ইত্যাদি।
সমাধান ঃ
(অ) নারিকেল গাছের ফল ধারণ বৃদ্দি,পরিচর্যা ও ফর ঝরা রোধ করণ ঃ
(১) সুষম সারের ব্যবহার করতে হবে। একটি ৫- ১০ বছরের নারিকেল গাছে (প্রতি বছর) জৈব সার ১৫ কেজি, ইউরিয়া ০১ কেজি, টি.এস.পি ৭০০ গ্রাম, এম.পি ১.৫৫কেজি, জিপসাম ৪০০ গ্রাম, জিংসারফেট ৩০ গ্রাম মিশ্রণ করে দুই ভাগে ভাগ করে প্রতি বছর দুই বার প্রয়োগ করতে হবে ( ফেব্রুয়ারী ও আগষ্ট মাসে )। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কোপায়ে আলগা করে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে উপরে উল্লিখিত সারগুলি গাছের বয়স ৫ বছরের নীচে হলে উহার অর্ধেক এবং গাছের বয়স ১০ বছরের বেশী হলে উহার দেড়গুণ সার প্রয়োগ করতে হবে। (২) মাটির ধরন অনুসারে খরার সময় সেচ দিতে হবে এবং বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেয়া যাবে না। (৩) নারিকেলের বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। (৪) গাছের গোড়ায় গরু-মহিষ বাঁধানো বা মানুষ চলাচলের পথ রাখা যাবে না। (৫) নিষেকের পর ফুলে এক মাস পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে এক বার ২,৪-ডি (৬০ পিপিএম) স্প্রে করে ফল ঝরা কমানো যায় (গাংগুলি ও সাথীরা, ১৯৫৬)। (৬) গাছের সবুজ পাতা ছাটাই করা যাবে না। (৭) গাছে বন্ধা নারিকেল দেখা গেলে সুষম সার ও পানি ব্যবস্থাপনা করে সমস্যা সমাধান করা যায়।

(আ) রোগ দমন
(ক) মাইজ মরা/ কুঁড়ি পচা
এ রোগ ফাইটোপথোরা পালমিভোরা (Phytopthora palmivora)নামক এক প্রকার ছএাক দ্বারা হয়ে থাকে।
লক্ষণ ঃ (১) মাইজের পাতা প্রথমে হলুদ পরে বাদামী হয়ে মরে যায়। (২) নীচের পাতা ফিকে সবুজ, পরে গাঢ়বাদামী হয়। (৩) ক্রমানয়ে পুস্পমঞ্জুরি, ফল, কাঁদির সংযোগস্থল আক্রান্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। (৪) রোগ আক্রান্ত স্থান থেকে পচা গন্ধ বের হয়।(৪) রোগের মাএা কম হলে ফলন কমে যায় এবং মাএা বেশী হলে গাছ মরে যায়।
প্রতিকার ঃ (১) মরা ও শুকনা পাতা পরিস্কার করতে হবে। (২) আক্রান্ত অংশ কিছু টিসুসহ কেটে ফেলতে হবে। (৩) বোর্দোমিশ্রণ স্প্রে করতে হবে। (৪) রিডোমিল ০.২% হারে বা ডাইথেন-এম-৪৫ ০.৩% হারে স্প্রে করতে হবে।
(খ) পাতায় দাগ পড়া
এ রোগ নারিকেল গাছের পাতায় দেখা যায়। এ কারণ হল পেসটালোডিয়া পালমেরিয়াম (Pestalotia palmarum) নামক এক প্রকার ছএাক।
লক্ষণ ঃ (১) প্রথমে পুরাতন পাতার উপর চোট ছোট হলুদ রং এর দাগ দেখা যায় এবং চার পার্শ্বে ধুসর বর্ণের বেষ্টনী থাকে। (২) রোগ বৃদ্বির সাথে সাথে দাগের কেন্দ্রস্থল বড় ধুসর বণ আকার ধারন করে এবং কিছু অংশ মরে যায়। (৩) শেষ পর্যন্ত পাতার আগা, কিনারা ও পরে স¤পূর্ণ পাতা শুকাইয়া মরে যায়। (৪) পাতা নষ্ট হওয়ার ফলেগাছ দুর্বল হয়ে যায় তাই ফল কম ধরে বা ফল হলেও ঝরে পড়ে।
প্রতিকার ঃ (১) আক্রান্ত পাতা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। (২) গাছ পরিস্কার রাখতে হবে। (৩) সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। (৪) ডাইথেন-এম-৪৫ ০.৩% হারে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। (৫) বাভিসটিন বা টিলট ০.২% হারে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
(গ) কাণ্ডের রস ঝরা / পানি ঝরা (Stem bleedig)
গাছের কাণ্ড লম্বালম্বি ভাবে ফেটে রস ঝরতে থাকে। সেরাটোসাইটিস পেরাডোসা (Ceratocystis paradoxa) নামক এক প্রকার ছএাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
লক্ষণ ঃ (১) কাণ্ড ফেটে যায় এবং উক্ত স্থান থেকে বাদামী বর্ণের রস ঝরতে থাকে। (২) উক্ত স্থান শুকে কালো ও শক্ত চাপড়ারমত হয়ে যায়। (৩) ক্ষতস্থান কাটলে হলদে বাদামী বর্ণে তন্ত পাওয়া যায় এবং রস সঞ্চালন নালী ছাড়া সব তন্ত নষ্ট হয়ে যায়। (৪) আক্রান্ত স্থানে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। (৫) ছোট গাছ হলে এক বছরে এবং বড় গাছ হলে ২-৩ বছরে মরে যায়। (৬) আক্রন্ত গাছে ফল কম হয়।
প্রতিকার ঃ (১) ট্রি (গাছ) সার্জারীর মাধ্যমে আক্রান্ত অংশ পরিস্কার করে আগুনে পুড়ে ফেলতে হবে। ( ২) সুস্থ টিসুসহ আক্রান্ত স্থান চেছে বোর্দোমিশ্রণ বা আলকাতরা লেগে দিতে হবে। (৩) গাছ পরিস্কার রাখতে হবে। (৪) গরম আলকাতরার সাথে কাঠের গুড়া দিয়ে গর্ত বন্ধ করে দিতে হবে।
(ঘ) ট্যাপারিং
এটি একটি ফিজিওজিক্যাল রোগ।
লক্ষণ ঃ (১) কাণ্ডের অগ্রভাগ ক্রমশ লম্বা ও সরু হয়ে যায়। (২) পাতা কমে যায় এবং ফল ধরা কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায়। (৩) আক্রমণ বেশী হলে গাছ মারা যেতে পারে। (৪) গাছের মাথা সরু হয়ে ভেঙে যায়।
প্রতিকার ঃ (১) এ রোগ সব চেয়ে বেশী হয় গাছে অপুষ্টির কারণে তাই সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। (২) জলাবদ্ধতা বা কংকর মাটির কারনেও এ রোগ হতে পারে তাই গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেয়া যাবে না এবং সঠিক পরিচর্য়ার মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায়।

(ই) পোকামাকড় দমন ঃ
(ক) গন্ডার পোকা
যে সব পোকা নারিকেলের ক্ষতি করে তার মধ্যে এ পোকা অন্যতম। বাংলাদেশে এ পোকাকে গবুরে পোকা বলা হয়। গণ্ডারের মত শিং থাকে বলে একে গণ্ডার পোকা বলা হয়।
ক্ষতির লক্ষণ ঃ (১) পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাছের কচি ডগা আক্রমণ করে এবং গর্ত খুড়ে তার মধ্যে প্রবেশ করে। (২) কচি পাতার গোড়া এবং ফুলবতী কাদিঁর গোড়া কেটে দেয়। (৩) গাছের কেন্দ্রাংশের নরম টিসু এদের আক্রমনের প্রধান লক্ষণ। (৪) আক্রমন বেশী হলে গাছের মাথা মরে যায় এবং ফলের সংখ্যা কমে যায়।
প্রতিকার ঃ (১) বাগানের মধ্যে ও আশেপাশে গোবর ও আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে হবে। (২) আলোর ফাঁদ পেতে পোকা মারতে হবে। (৩) গর্তে শিক ঢুকে পোকা মারতে হবে। (৪) ডাইমেক্রম ১০০ ইসি ১৫ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করতে হবে।
(খ) লাল কেরী পোকা 
সাধারনত ৫-২০ বছর বয়েসের নারিকেল গাছে এদের আক্রমন বেশী দেখা যায়।
ক্ষতির লক্ষণ ঃ (১) এ পোকার বাচ্ছা বা গ্রাব পএ মুকুটের গোড়ার দিকে গর্ত করে ভিতরে ঢুকে কোষ-কলা খেতে থাকে। (২) এদের আক্রমনের অন্যতম লক্ষণ হল ছিদ্রের মুখে বাদামী বর্ণের চটচটে গদের আটার মত উজ বা চিবানো কাঠের গুড়ার মত দেখা যায়।
প্রতিকার ঃ (১) বাগানের মধ্যে শুকনো লতাপাতা বা গোবর, আবর্জনা ধংস করে ফেলতে হবে। (২) আলোর ফাঁদ পেতে পোকা মারতে হবে। (৩) গর্তে শিক ঢুকে পোকা মারতে হবে। (৪) ডাইমেক্রম ১০০ ইসি ১৫ মিলি ১০ লিটার পানিতে মিশে স্প্রে করতে হবে।
(গ) ইদুঁর দমন ঃ
ইদুঁর দ্বারা প্রতি বছর নারিকেলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে ( এক গবেষণায় দেখা যায় মোট উৎপাদনের ১০% ইদুঁর র্দ্বা নষ্ট হয়)। বাগানের যত্ন না নিলে বা গাছ বেশী ঘন হলে ইদুঁর এক গাছ থেকে আর এক গাছে চলাচল করে ও আক্রমন বেশী হয়।
প্রতিকার ঃ (১) গাছের গোড়া থেকে কিছু উপরে (এক বা দুই মিটার উপরে) কাণ্ডের চার পার্শ্বে ঘুরিয়ে টিনের পাত দিয়ে চ্যাপ্টা রিং পরিয়ে দিলে ইদুঁর গাছে উঠতে পারে না। ( ২) রেকুমিন বা জিংক ফসফাইড (ইদুঁর মারার বিষ) বিষটোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। উপরের পরামর্শসমুহ অনুযায়ী কাজ করতে পারলে সহজে নারিকেলের ভাল ফলন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

Exit mobile version