কৃষিসংবাদ

বোরো মৌসুমের চাষাবাদের উপযোগী ধানের নতুন একটি জাত ‘বিনা ধান-১৮’

ড. এম. মনজুরুল আলম মন্ডল*

বিনাধান-১৮ বোরো মৌসুমের চাষাবাদের উপযোগী নতুন একাটি জাত যা পরমাণু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে। জাতটির বৈশিষ্ট্য ব্যাপারে প্রধান গবেষক ড. মোঃ আবুল কালাম আজাদ, সি.এস.ও বলেনঃ এটি উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের জাত। উচ্চ ফলণশীল বোরো ধানের জাত ব্রি ধান-২৯ এর চেয়ে ১২-১৫ আগে পাকে অথচ ব্রি ধান-২৯ এর সমান ফলন দেয়। গাছ শক্ত বলে হেলে পড়ে না । পাতা গাঢ় সবুজ, লম্বা ও চওড়া। ডিগ পাতা খাড়া। জীবনকাল- বোরো মৌসুমে ১৪৫-১৫০ দিন । যথোপযুক্ত পরিচর্যায় বোরো মৌসুমে হেক্টর প্রতি ৭.৫-৮.০ টন ফলন দেয়। রান্নার পর ভাত ঝরঝরে হয় এবং দীর্ঘক্ষণ রাখলে নষ্ট হয় না। জাতটি বিভিন্ন রোগ যথা পাতা পোড়া, খোল পঁচা ও কান্ড পঁচা ইত্যাদি রোগ তুলনামূলকভাবে বেশী প্রতিরোধ করতে পারে। এছাড়া এই জাতটির প্রায় সব ধরনের পোকার আক্রমন, বিশেষ করে বাদামী গাছ ফড়িং, গলমাছি ও পামরী পোকার আক্রমন প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী। বিনাধান-১৮ বোরো মৌসুমের জন্য আনুমোদিত হলেও জাতটি আউস মৌসুমে চাষ করা যায়।

আঞ্চলিক উপযোগীতা : লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের প্রায় সকল মধ্যম উচুঁ ও মধ্যম নিচু জমিতে বিশেষ করে বৃহত্তম রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, যশোহর, ঢাকা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে জাতটির অধিক ফলন পাওয়া যায়।

চাষাবাদ পদ্ধতি: জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী বোরো জাতের মতই। নিম্নে জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি দেয়া হ’লঃ

বীজ হার, বীজ বাছাই ও শোধন: প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০ কেজি বা একর প্রতি ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। ভারী, পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করুন এবং বপনের আগে বীজ শোধন করা ভাল।

বীজতলা তৈরী: বোরো মৌসুমে অঞ্চল ভেদে ২০ কার্তিক থেকে ৫ অগ্রহায়ন পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ (২০০ বর্গ মিটার) পরিমাণ বীজতলায় ১০ কেজি বীজ ফেলা যায়।

চারার বয়স ও রোপন পদ্ধতি: বোরো মৌসুমে ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপন কলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। তবে ৫০ দিনের চারা রোপন করলেও তেমন ক্ষতি হয় না। বেশী বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই বোরো মৌসুমের জন্য ৬ সপ্তাহের বেশী বয়সের চারা রোপন করা কোন অবস্থাতেই উচিৎ নয়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপন করলে ফলন বেশি হয়। রোপনের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। প্রতি গুছিতে একটি করে সতেজ চারা রোপন করাই যথেষ্ট। প্রয়োজনে ২-৩ টি সুস্থ-সবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপন করা যেতে পারে। সারি থেকে সারির দূরত ২০-২৫ সেঃমিঃ এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সেঃমিঃ থাকা ভাল। চারা রোপনের ৭-১০ দিনের মধ্যে কোন চারা মারা গেলে সেখানে নতুন চারা রোপন করতে হবে।

সার প্রয়োগ মাত্রাঃ
সারের নাম                             বীজ তলার জন্য                                          রোপা ক্ষেতের জন্য
                             প্রতি হেক্টরে   প্রতি একরে     প্রতি শতাংশে          প্রতি হেক্টরে   প্রতি একরে   প্রতি বিঘায়
ইউরিয়া (কেজি)  ১০০-১২০        ৪০-৫০              ০.৪-০.৫            ২২০-২৫০         ৯০-১০০         ৩০-৩৫
টিএসপি (কেজি)  ৮০-১০০         ৩২-৪০              ০.৩-০.৪            ১১০-১২০           ৪৫-৫০           ১৪-১৭
এমওপি (কেজি)  ৩০-৫০            ১২-২০              ০.১-০.২             ১৪০-১৭০           ৫৫-৬৫          ১৮-২৩
জিপসাম                —                   —                    —                       ৬৫-৮০             ২৫-৩০           ৮-১০
দস্তা                        —                   —                    —                        ৮-১০                 ৪.০০-৪.৫০     ১.৫

রোপন জন্য জমি তৈরীর শেষ চাষের আগে সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং দস্তা জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে চাষের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর এবং বাঁকী অর্ধেক ৩০-৩৫ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে অথবা এক তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ৭-৮ দিন পর, এক তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ১৮-২০ দিন পর এবং শেষ তৃতীয়াংশ চারা রোপনের ৩০-৩৫ দিন পর জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে প্রয়োগ করতে হবে। অনুর্বর জমিতে হেক্টর প্রতি বোরাক্স ২-৩ কেজি (একর প্রতি ১ কেজি) এবং দস্তা সার ৪-৫ কেজি (একর প্রতি ২ কেজি) হারে দেয়া যেতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ২/১ দিন আগে জমির অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে আগাছা দমন করতে হবে। জমির উর্বরতা ও ফসলের অবস্থায় উপর নির্ভর করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে।

পরিচর্যা : এই জাতের ধানের পরিচর্যা অন্যান্য উফশী জাতের মতই। চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে দ্রুত নিড়ানী যন্ত্র বা হাতের সাহায্যে আগাছা পরিস্কার ও মাটি নরম করতে হবে। চারা রোপনের পর থেকে জমিতে ৫-৭ সেন্টিমিটার (২-৩ ইঞ্চি) পানি রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ধান গাছে যখন কাইচথোড় আসা শুরু করে তখন পানির পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো উচিত। ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভাল।

রোগ ও পোকা মাকড় দমন : রোগ বালাই ও কীট পতঙ্গের আক্রমণ দেখা দিলে নিকটস্থ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার উপদেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা নিলে প্রচলিত তরল বা আনাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া খোলা ঝলসানো, ব্যাক্টেরিয়াল লিফব্লাইট বা পাতা ঝলসানো ও অন্যান্য রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। খোল ঝলসানো, কান্ড পচাঁ রোগ দেখা দিলে বেনলেট, হোমাই, বেভিষ্টিন বা টপসিন মিথাইল মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োাগ করা যেতে পারে।

ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ: শিষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিষ ভেঙ্গে যায়। শিষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। মাড়াই করার পর ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে গোলাজাত করতে হবে।

*প্রিন্সিপাল সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইলঃ ০১৭১৬৭৪৯৪২৯

Exit mobile version