কৃষিসংবাদ

বৈজ্ঞানিক ভাবে লাভজনক বাটা মাছ চাষ করার সহজ উপায়

লাভজনক বাটা মাছ চাষ

ড. নাজনীন বেগম, ড. এএইচএম কোহিনুর ও মো. মশিউর রহমান

লাভজনক বাটা মাছ চাষ

বাটা মাছ একই পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা হয়। মিশ্রচাষে পুকুরের বিভিন্ন স্তরের খাবারের পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কার্পিও ও গ্রাসকার্প ইত্যাদি মাছের সাথে বাটা মাছ চাষ করা হয়।

মিশ্রচাষের জন্য পুকুর নির্বাচনে নিচের বিষয়সমূহ লক্ষ্য রাখতে হবেঃ
ক্স মিশ্রচাষের জন্য কমপক্ষে ৮-১০ মাস পানি থাকে এ রকম, অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির পুকুর হলে ভাল হয়।
ক্স পুকুরের আয়তন ২০ শতাংশের চেয়ে বড় এবং পানির গড় গভীরতা ৫-৬ ফুট থাকা আবশ্যক।
ক্স পুকুর পাড়ে বড় গাছ-পালা না থাকা বাঞ্ছনীয়।

পুকুর প্রস্তুতির ধাপসমূহঃ মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতির গুরুত্ব অপরিসীম। মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ও রোগমুক্ত থাকার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পুকুর প্রস্তুতি আবশ্যক। তাই পোনা মজুদের পূর্বে ভালোভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।

ক্স পুকুরের পাড়ভাঙ্গা থাকলে মেরামত করে বা বেঁধে মজবুত করতে হবে।
ক্স পুরাতন পুকুরের তলদেশে পঁচা কাদা থাকলে তা তুলে ফেলতে হবে।
ক্স পাড়ে ঝোপঝাড় থাকলে লতাপাতা পুকুরে পড়ে পঁচে গিয়ে পানি নষ্ট করতে পারে। মাছ খেকো প্রাণী যেমন : সাপ, উদবিড়াল, গুইসাপ পানিতে আশ্রয় নিয়ে মাছ খেতে পারে। তাই পুকুরের আগাছা, পাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে।
ক্স পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম (৪ফুট পানির গভীরতায়) রোটেনন প্রয়োগ করে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করতে হবে।
ক্স অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করার পর প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি চুন সমস্ত পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স চুন প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৬-৮ কেজি হারে কম্পোষ্ট সার সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
ক্স কম্পোষ্ট সার প্রয়োগের ৩ দিন পরে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পুকুরে ব্যবহার করতে হবে।

পোনা মজুদ

পোনা মজুদের হার
ক্স ভাল উৎপাদন পাওয়ার জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা উচিত।
ক্স প্রতি শতাংশে ১০-১২ সেমি. আকারের ৪৫-৬০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
ক্স পোনা প্রাপ্তির ওপর মজুদের সময় নির্ভর করে। তবে মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত মাছ দ্রুত বাড়ে বিধায় পোনা মার্চ মাসের মধ্যেই মজুদ করতে পারলে ভাল হয়। মিশ্রচাষের জন্য পোনা মজুদের সংখ্যা সারণি-১ এ দেয়া হলো।

সারণি-১. মিশ্রচাষের জন্য নির্বাচিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা
মাছের প্রজাতি                    প্রতি শতাংশে সংখ্যা
বাটা                                           ১৫-২০
রুই                                            ৬-৮
কাতলা                                      ৩-৪
মৃগেল                                       ৮-১০
সিলভার কার্প                           ৯-১২
কার্পিও                                      ২-৩
গ্রাসকার্প                                  ২-৩

মোট                                      ৪৫-৬০


ক্স পুকুরে প্রচুর পরিমাণে মাছের প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য পোনা মজুদের এক সপ্তাহ পর থেকে সার প্রয়োগ করতে হবে।
ক্স প্রতি শতাংশে প্রথম সপ্তাহে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে এবং পরবর্তী সপ্তাহে প্রতি শতাংশে ৪-৬ কেজি কম্পোষ্ট সার দিতে হবে।
ক্স এভাবে পর্যায়ক্রমে অজৈব ও জৈব সার পুকুরে প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন ভাল হয়।
ক্স পুকুরের পানি যদি অত্যধিক সবুজ রং ধারণ করে তা হলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ
ক্স পুকুরে ব্যবহৃত সারে যে প্রাকৃতিক খাদ্যকণা জন্মে তাতে মাছের পুষ্টি সম্পূর্ণ হয় না, তাই মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে।
ক্স সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কূঁড়া (৮০%), সরিষার খৈল (১৫%) ও ফিশমিল (০৫%) এর মিশ্রণ পুকুরে সরবরাহ করা যেতে পারে।
ক্স মাছ ছাড়ার ১৫ দিন থেকে প্রতিদিন সকালে মজুদকৃত মাছের ওজনের শতকরা ২-৫ ভাগ সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে।
ক্স সপ্তাহে ১ দিন সম্পূরক খাবার বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া মেঘলা দিনে খাদ্য সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ক্স মাছ মজুদের পর প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের নমুনায়নের মাধ্যমে ওজন জেনে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

ব্যবস্থাপনা
ক্স পুকুরে সর্বদা আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে।
ক্স পুকুরের পানি দ্রুত কমে গেলে অন্য কোন উৎস হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্স পানির স্বচ্ছতা ৮ সেমি. নিচে নেমে গেলে সার ও খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
ক্স পানিতে অক্সিজেনের অভাব হলে মাছ পানির উপরে উঠে খাবার খেতে থাকে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বা অক্সিজেন বৃদ্ধিকারক ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
ক্স মাঝে মাঝে হররা টেনে পুকুরের তলার বিষাক্ত গ্যাস দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।

মাছ আহরণ
ক্স উল্লিখিত পদ্ধতিতে ৬-৭ মাসে এই মাছ খাবার উপযোগী এবং বিক্রিয়যোগ্য হয়।
ক্স মাছ ধরার জন্য ঝাকি জাল বা টানা বেড়জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্স এ পদ্ধতিতে মাছের মিশ্রচাষ করে হেক্টর প্রতি এক ফসলে ৫.৫-৬.০ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।

Exit mobile version