কৃষিসংবাদ

মা ইলিশ সংরক্ষণ ও ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল

 ইলিশ উৎপাদনেও বাংলাদেশ রোল মডেলড. ইয়াহিয়া মাহমুদ

ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল

ইলিশের জীবন চক্র বৈচিত্রময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেয়ার জন্য মিঠাপানিতে ডিম দেয়ার পর ২২-২৬ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাঁচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তীতে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়ান করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশী ধরা পড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কম বেশী ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিন মাসের ১ম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত: ডিম ছাড়ে। এজন্য আশ্বিনের বড় পূণির্মার পূর্বের ৪দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ লক্ষ্যে গত ০১ অক্টোবর হতে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান পালিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ বছর নদীতে ৪৬.৪৭ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২.৪৭ শতাংশ বেশি। পোনা ছাড়ার সংখ্যা ৪২ হাজার কোটি।

দেশের ২৭ জেলায় ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হচ্ছে- চাঁদপুর, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম,কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এলাকাসমূহ হচ্ছে-ভোলা জেলার মুনপুরা ও ঢালচর এবং নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, কালিরচর ও মৌলভীরচর।

ইলিশের মোট আয়ুস্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে ২টি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর ১টি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরিতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত অভিপ্রয়ান করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬৫% এরও বেশী বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং ৩য় অবস্থানে ভারত (১৫-২০%)। উল্লেখ্য, ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উৎপাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন সাম্প্রতিককালে ৩০ শতাংশ বেড়ে ৫ লক্ষ মে.টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড় এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মেদির হাওড়েও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উৎপাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লক্ষ মে.টন; ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে তা হয় ৩.৯৫ লক্ষ মে.টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৫.০০ লক্ষ মে.টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিগত ৮ বছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ-যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। মা ইলিশ ও জাটকা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এখন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেকাংশে অনুসরণ করছে। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রমের জন্য চিহ্নিত এলাকাসমুহ হচ্ছে- বরিশাল জেলার সদর ও হিজলা উপজেলার কালাবদর নদীর ১৩.১৪ বর্গ কিলোমিটার, মেহেদিগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার গজারিয়া ও মেঘনা নদীর যথাক্রমে ৩০ এবং ২৭৪.৮৬ বর্গ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম এলাকার নদীসমূহের মোট দৈর্র্র্ঘ্য হচ্ছে ৮২ কি.মি. এবং আয়তন ৩১৮ বর্গ কিলোমিটার। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে এ এলাকাতেও মার্চ – এপ্রিল মাসে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। চলতি বছরে ইলিশ উৎপাদনের এই সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পেরেছে যে, মা ইলিশ ও জাটকা সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উৎপাদনের সুফল তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এজন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ রক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

(লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী )

Exit mobile version