কৃষিসংবাদ

সাথী ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন শেরপুরের কৃষকরা

সাথী ফসল চাষ

সাথী ফসল চাষ

মো. মোশারফ হোসাইন, শেরপুর প্রতিনিধি:

সাথী ফসল চাষ ঃ সাথী ফসলে সব দিকে লাভ। এমনটাই প্রমান করেছেন শেরপুরের নকলা উপজেলাধীন চন্দ্রকোনা ইউনিয়নরে বাছুরআলগা গ্রামের আবু রায়হান শামীম। পতিত জমিতে দুই বছর ধরে লেবু বাগানে গাছের ফাঁকে শাক-সবজি সহ বিভিন্ন আবাদ করে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন। একই জমিতে, এক খরচে, এক পরিশ্রমে, এক সাথে, একাধিক আবাদ পেয়ে তিনি লাভবান হচ্ছেন। তাই বলা চলে, সাথী ফসলে সব দিকেই লাভ। বহুবর্ষজীবী ফল-ফসল বা অন্যান্য আবাদে গাছের ফাঁকে ফাঁকে বছরে ৪ থেকে ৬ বার বিভিন্ন শাক সবজি চাষ করে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। শামীম এবছর লেবু গাছের ফাঁকে করলা, বিভিন্ন শাক ও মিষ্টি লাউ চাষ করে টাকায় লাল হয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
শামীম দীর্ঘ্য দিন ধরে রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ব্যবসার সুবাদে ঢাকার এক ধনাঢ্য পরিবারে বিয়ে করেন। হঠাৎ শামীমের বাবা মারা যাওয়ার পরে, তার মন ঘুরে যায়। সন্তানদের ঢাকার কোন এক স্কুলে ভর্তি রেখেই তিনি স্ত্রী নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে চলে আসেন তার গ্রামের বাড়ি নকলার বাছুরআলগাতে। শামীমের বাবা একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন, তাছাড়া একজন আদর্শ কৃষক হিসেবেও তাঁর বেশ সুনাম ছিলো। এ সুযোগে ছোট কালে শামীম তার বাবার সাথে কৃষি কাজে সহযোগিতা করতেন। এ সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং কৃষি অফিসের ওপর ভরসা করেই তিনি বাড়িতে এসে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেন।
শামীম ২০১৭ সালে রামপুর এলাকায় বছরে প্রতি একর জমি ৩০ হাজার টাকা করে, ৪ একর জমি এক লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তিতে লিজ নিয়ে তিনি কৃষি কাজের যাত্রা শুরু করেন। লাভ-লোকসানের চিন্তা করে এই জমি ১০ বছরের জন্য ডিড করে নেন। একবার লোকসান হলেও যেন, অন্য বছর তা পুশিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, এ পরিকল্পনা থেকেই তিনি ১০ বছরের জন্য চুক্তি করেন। প্রথম দিকে এলাকার অনেকে কৃষি কাজে তাকে নিরুৎসাহী করাসহ তার কাজে হাসাহাসি করলেও; পরে শামীমের সফলতা দেখে তারাই এখন তাকে অনুসরণ করছেন। তার দেখাদেখি অনেকে মিশ্র চাষে আগ্রহী হয়েছেন এবং এই পদ্ধতিতে আবাদ করে সফলতার মুখ দেখছেন তারা।
ফল ও শাক সবজির ব্যতিক্রমির এ মিশ্র চাষে শামীম বছরে যে পরিমাণ টাকা আয় করছেন, তা অন্য যেকোন একক আবাদের সমান। এ পদ্ধতিতে একই জমিতে, এক সাথে কয়েকটি শাক সবজি ও ফলফলাদির আবাদ করাতে বেশি লাভ মিলছে। তা দেখে এলাকার অনেকেই শামীমের মতো মিশ্র আবাদের দিকে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ সাথী বা মিশ্র ফসলের আবাদ করে লাভের মুখ দেখা শুরু করেছেন। অল্প জমিতে পরিকল্পনা মোতাবেক সাথী ফসল বা শস্যের আবাদ করায় ও লাভ বেশি পাওয়ায় এখানের কৃষকের নজর শুধু মিশ্র চাষের দিকে।
শামীম জানান, তার লিজ নেওয়া ওই ৪ একর জমিতে লেবু গাছ লাগিয়েছেন। তবে লেবু গাছ গুলো এখনও খুব বড় না হওয়ায় গাছের ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি লাউ, শীত বা পানি লাউ, করলা ও বিভিন্ন জাতের মৌসুমী শাক-সবজি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। এতে করে লিজ নেওয়া বছরের টাকা উঠে আসছে এ বাড়তি আয়েই। তার দেওয়া তথ্যে, প্রতি বছর তার বাগান থেকে অন্তত লাখ টাকা বাড়তি আয় হয়। তাছাড়া নিজের পরিবার ও স্বজনদের শাক সবজির চাহিদাও মিটছে তার এ বাগান থেকেই। নিজের পরিবার ও স্বজনদের চাহিদা মেটাতে অন্তত অর্ধলক্ষ টাকার শাক-সবজির প্রয়োজন, যার চাহিদা তার বাগান থেকেই মেটানো হচ্ছে। এ হিসেবে প্রধান আবাদ লেবু এখনও বাজার জাত করা শুরু না হলেও, লোকসান হচ্ছেনা। যদিও জমি লিজ বাবদ খরচ বাদেও প্রথম বছর (২০১৭ সাল) জমি তৈরী, বেড়া দেওয়া, শ্রমিক খরচসহ বিভিন্ন ভাবে খরচ বেশি হওয়ায় বেশ লোকসান গুনতে হয়েছিলো তার। তবে পরের বছর থেকে লাভ না হলেও, আপাতত তাকে লোকসান গুনতে হচ্ছেনা। তিনি জানান, প্রতি মৌসুমে ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ জমিতে বছরে ৪ থেকে ৬ বার শাক চাষ করেন, এতে প্রায় অর্ধলাখ টাকা লাভ হয়। চলতি বছরের শীত মৌসুমে ওই লেবু বাগানের দেড় একর জমিতে মিষ্টি লাউ, ৫০ শতাংশ জমিতে করলা, ৪০ শতাংশ জমিতে লাল শাক চাষ করে লাভবান হয়েছেন। বর্তমানে লাল শাক শেষের দিকে। এখন চলছে লাউ ও করলা বিক্রির ধুম। তিনি প্রতিটি মিষ্টি লাউ ও শীত লাউ ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছেন। প্রতিদিন কোন না কোন এলাকার পাইকার তার মাঠ থেকে শাক-সবজি নিয়ে বিক্রির জন্য স্থানীয় চন্দ্রকোনা, রামপুর ও রৌহা বাজার, শেরপুর সদর বাজার, নালিতাবাড়ী, নকলা, ময়মনসিংহের পিয়ারপুর ও নুরুন্দী বাজারসহ বিভিন্ন বাজারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। এতে করে শামীমকে তার উৎপাদিত ফসল বাজার জাত করার জন্য বাড়তি চিন্তা করতে হচ্ছেনা, পাশাপাশি তার ক্ষেতের শাক সবজি বিক্রি করে, তা থেকে লাভের টাকায় সংসার চলছে অন্তত ১৫ ব্যবসায়ীর। তার ক্ষেতে শ্রম বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন স্থানীয় ৫-৭ টি দরিদ্র পরিবার। তার বাগানে লেবু উৎপাদন শুরু হলে খরচ বাদে শুধু লেবু থেকে বছরে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন। তাছাড়া বাগানে করা সাথী ফসল থেকে বছরে অন্তত ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব বলে তিনি জানান। তার বাগানের চারপাশে দেশীয় জাতের পেঁপে রোপন করেছেন। এখানে উৎপাদিত পেঁপে বিক্রি করা সম্ভব না হলেও, নিজের পরিবার ও স্বজনদের চাহিদা মিটানো সম্ভব হচ্ছে।
এবিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার পরেশ চন্দ্র দাস জানান, নকলার অধিকাংশ এলাকার মাটি দোআঁশ হওয়ায় এখানে লেবু ও বিভিন্ন শাক-সবজির উৎপাদন ভালো হয়। তাই যেকেউ চাইলে লেবু বাগানে সাথী ফসল করে স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। এতে স্বাবলম্বী হবেন অনেকে , কমবে বেকারত্ব, বাড়বে আত্মনির্ভরশীলতা। তাই এধরনের কৃষি কাজে উৎসাহি করতে কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগীতা দেওয়ার আশ্বাস দেন কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস।

Exit mobile version