কৃষিসংবাদ

৭২ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনায় প্রান্তিক কৃষক ও খামারিরা উপকৃত হবেনা

প্রনোদনায় প্রান্তিক কৃষক

প্রনোদনায় প্রান্তিক কৃষক

শাহ এমরানঃ

প্রনোদনায় প্রান্তিক কৃষক : বাজেট ঘোষনার পর সামাজিক গনমাধ্যমে দেখেছি অনেকে হিসাব করা শুরু করেছেন এতগুলো টাকা যদি জনপ্রতি ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে ৪০০০ টাকার মত পেলে চাল ডাল কিনে কি একমাস চলা যাবে এই দূর্যোগ মূহুর্তে! প্রনোদনা নিয়ে বিষয়টা হাস্যকর মনে হলেও এর মাঝে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের একটা বাস্তব চিত্র আছে। আপনার আমার পকেটে টাকা আছে, একজন দিনমজুর, কৃষক, প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি তাদের পকেটে টাকা নেই। প্রনোদনা আর সাহায্য দুটো ভিন্ন বিষয়।

সাহায্যকে বলা যেতে পারে দান, যা আর আপনাকে ফেরত দিতে হবেনা। প্রনোদনা হলো আগের থেকে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দেয়া। এই দূর্যোগ মূহুর্তে বড় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এই সুবিধাই বা কম কি! তবে দু:খের বিষয় হলো, ৭২ হাজার টাকার এই প্রনোদনায় দেশের খেটে খাওয়া ক্ষুদ্র দোকানী, ব্যবসায়ী, কৃষক ও খামারিদের অধিকাংশই সুবিধা বঞ্চিত থাকবে। কেন পাবেনা এই বিষয়টা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাই। প্রনোদনার ৪ টি প্যাকেজের মধ্যে ১ম প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের জন্য কম সুদে ঋন ব্যবস্থা এবং ২য় প্যাকেজে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলা হয়েছে যেখানে ৯% সুদে ঋন সুবিধার মধ্যে লোন গ্রহীতা ৪.৫০% ঋন সুবিধা পাবেন, বাকী সুদ সরকার ভূর্তকী দেবে। এই প্যাকেজগুলোতে স্পষ্ট করে বলা আছে ব্যাংক এবং ক্লায়েন্ট রিলেশনশীপের মধ্য দিয়ে এই ঋন সুবিধা দেয়া হবে। আমি যেহেতু ডেইরি ইন্ডাস্ট্রির বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করি স্বাভাবিকভাবে আমার দৃষ্টি এখানেই ছিল বোঝার জন্য আমার দেশের ছোট প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা কোন সুবিধা পায় কিনা।আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই এই সুবিধা ছোট খামারিরা যা সত্যিকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তারা কেউই পাবেনা।

বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্পে ৯৯ লক্ষ মেট্রিকটন দুধ উতপাদন হয় প্রতিবছর। প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ দুগ্ধ খামারিদের মধ্যে প্রায় ৮৫% উপরের খামারিরা ক্ষুদ্র যারা গরু দুধ, মাংস বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। দুধ বিক্রি করে তাদের গরুর খাবার কিনতে হয় এবং নিজের ও পরিবারের জন্য আহার জোগাড় করতে হয়। দেশের এই মহাদূর্যোগে এই প্রান্তিক ছোট খামারিরা আজ সব থেকে বেশী বিপর্যস্ত। দুধ বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছে বা অর্ধেকের কমদামে বিক্রি করে প্রতিদিন লোকসান গুনেছে। ৭২ কোটি টাকা প্রজেক্টের একটি টাকাও তাদের কাছে যাবেনা কারন ৮৫% উপরের খামারি ও কৃষকরা ব্যাংক একাউন্ট মেইন্টেন করেনা, তাদের কোন ট্রেড লাইসেন্স নেই, তাদের কোন ব্যাংক লেনদেন নেই। তারা শুধুমাত্র দিন আনে দিন খায়। একটি বানিজ্যিক ব্যাংক কিভাবে ঋন দেয় ১৭ বছরের আমার ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ খানিকটা জানার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনদিন কোন কৃষক খামারিদের ঋন দেবেনা ট্রেড লাইসেন্স, ২ বছরের ব্যাংকিং লেনদেন না থাকলে। পাশাপাশি জায়গা জমি মর্টগেজতো দিতেই হবে। প্রতি বছর বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কৃষিখাতে ঋন দেবার জন্য একটি টার্গেট দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা কৃষিখাতে ঋন আকারে দিতেই হবে।

আপনারা শুনে অবাক হবেন এই ঋনের অধিকাংশটাই বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো এনজিওদের বরাদ্দ দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের এই এনজিও গুলোর অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এনজিওগুলো নানা ব্যবসার সাথে জড়িত এবং কৃষিখাতের এই ঋনগুলো তুলে তারা উচ্চ সুদে ঋন দেয় গরীব খামারিদের এবং তাদের অন্যান্য প্রজেক্টে ফান্ড ডাইভার্ট করে নিজের আখের গোছাতেই ব্যাস্ত থাকে। যারা সত্যিকারভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এই মহাদূর্যোগে আসলেই কি পাবে তারা কোন সুবিধা! আজকে খামারিদের এই দূর্যোগে দুগ্ধ প্রসেসর কোম্পানীগুলো পাবে প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা। যদিও তারা খামারিদের দুধ নেয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে তথাপি তাদের লোকসানের খাতার হিসাব থাকবে অনেক বড়। আবারো পাবে তারা কম সুদে লোন, আবারো হবে সেই ফান্ড অন্যদিকে ডাইভার্ট এবং দেশের গরীব চিরদিন গরীবই থাকবে।বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসাবে আমরা চেস্টা করেছিলাম নিম্নের বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী বরাবর পৌছাতে।

স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী করনীয়ঃ দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুগ্ধ খামার শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা ও যে কার্যক্রমগুলো হাতে নেয়া যেতে পারে তা নিম্নরুপ-

ক. বাংলাদেশ এভারেজ গাভীর দুধ উতপাদন হিসাবে প্রতি দুগ্ধ গরু খাওয়া খরচ প্রতিদিন হিসাবে গড় পড়তা আসে নূন্যতম ১৬০ থেকে এবং সর্বচ্চ ২৫০ টাকা। গরীব খামারিরা যেহেতু দুধ বিক্রি করে আয় করতে পারেনি। গাভীকে প্রতিদিন খাওয়াতে হয়েছে, তাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসা পর্যন্ত দিন হিসাবে গাভী প্রতি আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে স্বল্প মেয়াদী এই দূর্যোগ কাটিয়ে উঠতে।

খ. সমস্যা কাটিয়ে উঠার জন্য আগামী ৩ মাস বিদ্যুত ও পানির বিল মওকুফ করা উচিত স্বল্পমেয়াদী সহযোগিতা মাধ্যমে।

গ. দীর্ঘ মেয়াদে যে কাজগুলো করা যেতে পারে সমস্যা মোকাবেলায় এবং ভবিষ্যতে এই শিল্পকে আরো শক্তিশালী করতে তা নিম্নরুপঃ বিনা সুদে খামারিদের ঋন সুবিধা দেয়াদেশের প্রতিটা উপজেলায় খামারিদের দুধ, ডিম, মাংস ইত্যাদি সংরক্ষনের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিজস্ব হাট/বাজার তৈরীর মাধ্যমে উতপাদিত পন্য বিক্রির ব্যবস্থা করা। উপজেলা ভিত্তিক খামারিদের দুধ সংগ্রহ ও দুগ্ধ জাতীয় পন্য তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ বিনামূল্যে সরবারহ করা। জেলা ভিত্তিক দুগ্ধ প্রসেসর কোম্পানীদের দুধ সংগ্রহের প্ল্যান্ট তৈরী করা এবং উপজেলা খামারিদের দুধ সংগ্রহ করে গুড়া দুধ সহ নানাবিধ দুগ্ধজাত পন্য তৈরী করা। বিদেশ থেকে গুড়া দুধ আমদানীর উপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা এবং দেশীয় শিল্পকে প্রনোদনা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রতি লিটার দুধ উতপাদন খরচ কমানোর জন্য পশু খাদ্যের সিন্ডিকেট প্রতিহত করা, পোর্টে পশু খাদ্য দ্রুত রিলিজের ব্যবস্থা করা, পশু খাদ্য আমদানী, প্রসেসরকে খাদ্যের মূল্য একটি নির্দিষ্ট দামে বেধে দেয়া। খামারের বিদ্যুত বিল, পানির বিল, জমির খাজনা কৃষির আওতায় আনা। বর্তমানে প্রতিটা খামারিকে বানিজ্যিক বিল ও খাজনা পরিশোধ করতে হয়। আধুনিক কৃষি মেশিনারিজ ও যন্ত্রপাতি আমদানীতে শুল্ক পরিহার করা দুধ খাবার ব্যাপারে জনগনের মাঝে উতসাহ বাড়াতে সরকার থেকে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দেয়া এবং সরকারী পর্যায় থেকে গার্মেন্টস/শ্রম শিল্প কর্মচারী ও স্কুল কলেজের ছাত্রের টিফিনের সাথে জড়িত প্রতিদিনের খাবার ম্যেনুতে দুধ, দই বাধ্যতামূলক করা। বিগত ১০ বছরের মুদ্রাস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তরল দুধের একটি ন্যায্যমূল্য নির্ধারন করে দেয়া। সরকার নিজে সব কিছু করার চেয়ে দেশের প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করতে হবে নানা প্রনোদনার মাধ্যমে। দেশের ডেইরি ইন্ডাস্ট্রিকে বাচাতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। আশাকরি একদিন নীতি নির্ধারকদের বোধদয় হবে।

লেখকঃ মহাসচিববাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন

Exit mobile version