কৃষিসংবাদ

বিষমুক্ত শাক-সবজী উৎপাদনে পরিবেশ বান্ধব জৈব ছত্রাকনাশক

পরিবেশ বান্ধব জৈব ছত্রাকনাশক

ড. মোঃ আবুল কাসেম:

সবজী মানবদেহের সুস্থ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সহজলভ্য পুষ্টি উপাদান। অভিজ্ঞ ডাক্তারগণ সুস্বাস্থ্যের জন্য দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় একাধিক সবজী রাখার পরামর্শ দেন। “আমেরিকার ক্যান্সার সোসাইটি” খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে ৫টি শাক-সবজী এবং “দি হারবাল স্কুল অব পাবলিক হেল্থ” সুস্বাস্থ্যের জন্য ৯টি বিভিন্ন শাক-সবজী রাখার সুপারিশ করেছেন। শাক-সবজী মানুষের বুদ্ধি-বৃত্তি, শারীরিক কর্মক্ষমতা ও চিন্তাশক্তির ভারসাম্যতা আনয়ন করে অসাধারন (Extraordinary) ক্ষমতা দান করে। ফলে এই সুস্থ্য ব্রেনে কোন উগ্রচিন্তা, জঙ্গীবাদিতা, উশৃংখলতা, উত্তেজনা স্থান পায়না। একজন মানুষের সার্বিক সুস্থ্যতার জন্য উচ্চ মাত্রার পুষ্টি উপাদান শাক-সবজীতে বিদ্যমান। শাক-সবজী দেহের ভিটামিন (সি, এ, কে) ও মিনারেলের (পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ছাড়াও ডায়েটরী ফাইবার) চাহিদা মেটায়, ক্ষতিকারক চর্বি শরীর থেকে বের করে আর্টারী পরিষ্কার রাখে, হার্ট ডিজিজ এর ঝুঁকি কমায়, পরিপাকতন্ত্রকে সচল রেখে সুগার নিয়ন্ত্রনে রাখে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এতে চর্বি ও ক্যালরী কম থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাওয়া যায় অথচ শরীরের ওজন বাড়ায় না। মনে রাখতে হবে উজ্জল ও টাটকা সবজী স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী। সবজীতে বিদ্যমান বিভিন্ন উপাদান রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে, দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখে, ত্বকের সুস্থ্যতা ও উজ্জলতা বৃদ্ধি করে, দাঁত ও মাড়ি সুস্থ্য ও মজবুত রাখে, পরিপাক যন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায়, কোষ্ঠ্য কাঠিন্য দূর করে, তাপমাত্রার সমতা রক্ষা করে, দ্রুত ক্ষত সারায় এবং বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে আছে বিশেষ ধরণের এন্টিঅক্সিডেন্ট পুষ্টি উপাদান যা শরীরের কোষের বিপর্যয় রোধ করে হৃদ রোগ, ক্যান্সার এবং হার্ট এ্যাটাক প্রতিরোধ করে যৌবনকে দীর্ঘায়িত করে। অথচ এই সবজী উৎপাদনে রোগবালাই দমনে যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার ক্ষতিকর প্রভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন: কিডনী, প্যানক্রিয়াস, লিভার, ফুসফুস, পরিপাকতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রগুলি কার্যকারিতা হারায় এবং আস্তে আস্তে শরীর রোগ সংবেদনশীল ও দূর্বল হয়ে পড়ে। কাজেই সবজী উৎপাদনে রোগবালাই দমনে রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের পরিবর্তে যদি জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয় তবে একদিকে যেমন বিষাক্ত রাসায়নিক বালাইনাশকের ক্ষতি থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করা যাবে অন্যদিকে দামেও সস্তা হওয়ায় আর্থিক সুবিধাও পাওয়া যাবে। তাছাড়া রাসায়নিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগে মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপকারী অনুজীবও ধ্বংস হয় এবং মাটির উর্ব্বরতা কমে যায়। এমনকি সবজীতে ব্যবহৃত রাসায়নিক ছত্রাকনাশক বৃষ্টির পানির সাথে নদীনালাতে মিশে জলজ প্রাণীরও ক্ষতি করে। এভাবে মাটি, পানি ও বায়ুসহ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। জৈব ছত্রাকনাশক পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। শুধু সবজীর/ফসলের টার্গেট প্যাথোজেনকে দমন করে কিন্তু অন্যান্য উপকারী অনুজীবের কোন ক্ষতি করে না। বরং বার বার ব্যবহারে মাটির গুণাগুণের উন্নয়ন এবং রোগদমনে উক্ত জৈব ছত্রাকনাশকের কার্যকরিতাও বেড়ে যায়। কাজেই স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে সবজী এমনকি অন্যান্য ফসল উৎপাদনে জৈব ছত্রাকনাশকের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ।

রোগ দমনে জৈব ছত্রাকনাশকের কার্যকারিতা রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের চেয়ে কম হলেও স্বাস্থ্য, পরিবেশ, মাটি, পানি, জলবায়ু ইত্যাদির ক্ষতির কথা চিন্তা করে এর ব্যবহার ও গবেষণা জোরদার করতে হবে। জৈব ছত্রাকনাশকের উপর গবেষণা আমাদের দেশে খুব একটা হয় নাই, ফলে এটার প্রাপ্যতা ও কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ পাশের দেশ ভারতে জৈব ছত্রাকনাশক বিভিন্ন নামে (যেমন-ভিরিডি, ট্রাইকো-কম্পোস্ট) পরিকল্পিতভাবে ফসলের রোগ দমনে ব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের সাথে যোগাযোগ করে এই জৈব ছত্রাকনাশক সংগ্রহ করা যায়। যেমন- উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মাজিম এগ্রো ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড, রাস এগ্রো এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি। জৈব ছত্রাকনাশকের ব্যবহারবিধি লেখকের মোবাইলে (+৮৮০১৭১৭১০১৮৭৪) যোগাযোগ করেও জানা যেতে পারে। জৈব ছত্রাকনাশক যেমন ট্রাইকো-ফানজিসাইড একটি উপকারী অনুজীবের দ্বারা সৃষ্ট তাই এদের ব্যবহার অন্যান্য রাসায়নিক সার বা বালাইনাশক থেকে ভিন্ন। কাজেই এব্যাপারে ব্যবহারকারীর কমপক্ষে ১ দিনের প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন।


লেখকঃ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান,উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ,বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট

Exit mobile version