মৌমাছি পালনে লাভ বেশি : বাংলার জলবায়ু মৌ চাষের উপযোগী

মৌমাছি পালনে লাভ বেশি

মোঃ মোশারফ হোসেন, শেরপুর ঃ

মৌমাছি পালনে লাভ বেশি

বাংলাদেশের বন, ফুল, ফল ও ফসলের মাঠ ও আবহাওয়া-জলবায়ু মৌ চাষের জন্য খুবই উপযোগী বলে মনে করেন নকলা উপজেলার বানেশ্বরদী খন্দকার পাড়া গ্রামের মেসার্স ফয়েজ মৌ খামারের স্বত্বাধিকারী ফয়জুর রহমান মাস্টার। তিনি ২০০০ সালে শেরপুর বিসিক থেকে মধু চাষের উপর এক মাসের প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখন একজন মৌ শিল্পের মালিক। প্রশিক্ষণ শেষে বিসিক থেকে মৌ চাষের একটি নমুনা বক্স নিয়ে তিনি এ পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তিনি ‘মেসার্স ফয়েজ মৌ খামার’ নামে মৌ চাষ প্রকল্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রায় ২০০ মৌ-বক্স, মধু নিস্কাশন যন্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রীর মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে প্রতিবছর ১১০ থেকে ১২০ মণ মধু উৎপাদন করছেন। যার পাইকারী বাজার মূল্য ১৫ লাখ টাকা থেকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তার লাভ দেখে উপজেলার অনেকেই মৌমাছে পালনে আগ্রহী হয়েছেন। নতুন করে আগ্রহীদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ও মনির উজ্জামান তারাও সফল মৌ-খামারীতে পরিনত হয়েছেন। নজরুলের ৫২ টি, মনিরের ৭০ টি, রাজবাহারের ১৭টি, মাহমুদের ২০টি, হালিমের ৭৫ টি, জহুরুলের ১১৪টি মৌ বক্স রয়েছে। মধু উৎপাদন করা পর্যন্ত প্রতি বক্সে ২-৩ হাজার টাকা ব্যয় হয় তাদের।

ফয়েজুর রহমান জানান, মধু উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, লক্ষ লক্ষ মৌমাছি ও উৎপাদন কাজ দেখবাল করার জন্য নিয়োগ করেছেন ৫ জন কর্মচারী। এদের সবার বেতন প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকার নিচে নয়। মধু উৎপাদন করা যায় সরিষা, ধনিয়া, পদ্ম, কালোজিরা, লিচু, আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল ও ফসলের মৌসুমে। নকলায় যথেষ্ট বনায়ন না থাকায় বছরের কয়েক মাস মৌ বক্সগুলো মধুপুর গড়সহ বিভিন্ন বনের নিকটে রাখা হয়। শুধুু মাত্র সরিষা, আম, জাম ও লিচুসহ মৌসুমি ফলের মৌসুমে এলাকাতে আনেন। জানা গেছে, প্রতি বক্সহতে বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৫ কেজি মধু পাওয়া যায়। মৌসুম ভেদে সরিষার মধু ১২হাজার, লিচুর ১৪ হাজার ,কালোজিরার মধুু ১৭ হাজার টাকা প্রতিমন হিসাবে বিক্রি করেন। স্থানীয় ভাবে এত মধু বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ মৌ চাষী সমিতির মহাসচিব সাতক্ষিরার আফজাল হোসেনের মাধ্যমে ভারত সহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বন্ধুদেশের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক গড়তে সহোযোগিতা করলেন এবং সহজ ব্যাংক ঋণ দিলে মৌ চাষে তারা নজীর ঘটাতে সক্ষম, এমনটাই মনে করছেন সুধিজন।

ফয়েজ আরও বলেন, আমি খামারের কর্মচারী ও যন্ত্র সামগ্রী নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে গাজীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, দিনাজপুর, ইশ্বরদী, পাবনা, জামালপুর, ও শেরপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পিং করে মধু আহরণ করছি। এতে আমার খামার হতে প্রতি বছর শতাধিক মণ মধু উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি কেজি মধু ৪০০ টাকা দরে স্থানীয় ভাবেই বিক্রি হয়ে যায়। ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে আমার উৎপাদিত কিছু মধু ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে। আমার এই প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক ব্যয় নির্বাহের পরও বর্তমানে প্রতি বছর ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। আমি এখন মধু চাষ করে সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্নতা বোধ করছি। তার দেয়া তথ্য মতে, চলতি সরিষার মৌসুমে নকলা উপজেলার উরফা ইউনিয়নের সরিষা চাষ অধ্যুষিত এলাকায় উরফা গোরস্থান দাখিল মাদরাসা মাঠে গত ১৫ দিন ধরে তার ক্যাম্প চলছে। সরেজমিনে দেখা যায়, খোলা মাঠে ১৬০টি বক্স বসিয়ে রাখা হয়েছে। মৌমাছির গুণগুণানিতে শুধু মাদরাসা মাঠ নয় পার্শ্ববর্তী বিশাল সরিষার মাঠে মৌ মৌ গ্রাণ ও গুণগুণানি শব্দে মুখর। সপ্তাহে একবার মধু নিস্কাশন করা হয়, বক্স গুলো থেকে প্রথম পর্বে প্রায় ৮মন মধু সংগ্রহ করেছেন তিনি। সেখানে যতদিন সরিষার ফুল থাকবে ততদিনই তার এ ক্যাম্প চলবে। তিনি আশা করছেন এখান থেকে আরো ২ থেকে ৩ বার মধু নিষ্কাাশন করা যাবে। প্রতি বক্সহতে বছরে গড়ে ১৫-২০ কেজি মধু পাওয়া যায়। তবে সরিষার মৌসুমেই মধুর পরিমাণ বেশি পাওয়া যায়। মৌসুম ভেদে সরিষার মধু ১২ হাজার,লিচুর ১৪ হাজার, কালোজিরার মধুু ১৭ হাজার টাকা প্রতিমন হিসাবে বিক্রি করাহয়। তার খামার পরিচালনায় তেমন কোন সরকারি সহায়তা নেই। ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠাতে সে আজ স্বাবলম্বী। তদুপরী বিভিন্ন সময়ে হয়ারানী ও কৃষকদের অসহযোগিতার দরুন মধু উৎপাদনে বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা ও শিক্ষিত কৃষকরা তাকে আন্তরিক সহযোগিতা করে থাকেন। অনেক কৃষকদের ধারনা, মৌমাছিরা যে সরিষা মাঠ থেকে মধু আহরন করে, সেখানে ফলন কম হয়। কিন্তু কৃষিবিদদের মতে, মৌমাছির ছোঁয়ায় ফুলে ও ফসলের উৎপাদন ৩০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মৌ চাষী ফয়েজুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশ মৌচাষের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। সরকারের বিনিয়োগ, পৃষ্ঠপোষকতা ও কর্মপরিকল্পনা থাকলে মধুতে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বহিঃবিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। কেননা বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের উৎপাদিত খাঁটি মধুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মৌ-চাষের উন্নতির জন্য সরকারকে ধান, পাট ও ইক্ষু গবেষনার ন্যায় মধু গবেষনা কেন্দ্র বা ইন্সটিটিউট স্থাপন করলে কৃষকরা তথা মৌ চাষিরা অর্থিক ভাবে লাভবান হবে বলে মনে করছেন মৌ খামারি ফয়জুর রহমানসহ অনেকেই। এতে করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কমবে বেকারত্ব, সমৃদ্ধ হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর জানান, কোন ফসলের মাঠের কাছে মৌবাক্স থাকলে সহজে পরাগায়ন হয়; ফলে ফলন অনেক বেশি হয়। মৌ চাষি এবং মধু উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষন সহ সবধরনের সহযোগিতা প্রদান প্রক্রিয়া চলছে বলে জানালেন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ। তবে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি বিভাগের বিশেষ প্রচারণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সুধিজন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *