পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি -সমাধান কোথায়, আমরা কেন স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারছি না ?

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি

বশিরুল ইসলাম

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি ঃ আগুনই বটে! দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গেলেই এমন আগুনের ছ্যাঁকা লাগছে ক্রেতাদের। নিম্মবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলের জীবনই হচ্ছে নাজেহাল। শুধু কি তাই, জীবনে প্রথম দেখলাম পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে হালি কিংবা জোড়া হিসেবে। আর একটি বড় আকারের পেঁয়াজের দাম ৮ থেকে ১০ টাকা হওয়ায় জাতীয় পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে ‘ ডিম, আপেলকে ছুঁয়ে বাড়ল পেঁয়াজের ঝাঁজ’। দেড় মাস আগে ভারত যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল, দেশের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পেঁয়াজের কেজি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯০ টাকায় বিক্রি শুরু করলো। আজ পর্যন্ত দামতো কমেই না বরং বেড়ে চলছে। আমাদের পেঁয়াজ বাজারে দাম নির্ভর করে মূলত ভারতে বাজারে উপর। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে আামদের দেশে পেঁয়াজ লাগামহীন হয়ে যায়। অথচ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ কিন্তু আমাদের রয়েছে।

একসময় আমাদের চালের খুবই সংকট ছিল । ভারত, ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করতে হত। এখন আমাদের সংকট নেই। আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। এটা দেশের চাল উৎপাদনের সামর্থ্যরেই বহিঃপ্রকাশ। এমনকি চাল আমরা কয়েকবার রপ্তানিও করেছি। এখন চাল উৎপাদনে আমরা চতুর্থ।

গরু নিয়ে ভারত আমাদের সাথে কত কাহিনী করেছিল। ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে ভেবেছিল আমরা গরু খাওয়াই ছেড়ে দিব। এখন সরকারের বিশেষ উদ্যোগে দেশে পর্যাপ্ত গরু উৎপাদন হচ্ছে। দেশের চাহিদা পূরণে আর গরু আমদানির প্রয়োজন নেই। আমাদের গরুর চাহিদা আমাদের খামারিরাই মিটিয়ে দিচ্ছে। ইলিশের অভাব ছিল। এখন সংকট নেই। অন্যান্য মাছের চাহিদাও চাষের মাধ্যমে পুরণ হচ্ছে। মাছ চাষেও আমরা চতুর্থ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে পেঁয়াজ কেন এখনো ভোগাচ্ছে! আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে?

আমার মতে চাল, গরু, মাছ সমস্যা আমরা যেভাবে করেছি, সেভাবে পরিকল্পনা করলে শতভাগ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন সম্ভব। একজন কৃষিবিদ হিসেবে আমি যতটুকু জানি, সে সমস্যার সমাধান আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা বের করে দিয়েছেন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে সেটার ব্যবহার নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট পেঁয়াজের গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন যে জাতগুলো উদ্ভাবন করেছে, সেগুলো নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে ব্যাপকহারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল। শীতকালের চাষকৃত পেঁয়াজ দিয়েই আমাদের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। যেহেতু দরকার মাত্র ৩০ শতাংশ, তাই একটা নির্দিষ্ট জোন বা এলাকায় চাষ করলেই চলে। কোন কোন এলাকা চাষ করা হবে আর কিভাবে কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী করে তুলতে হবে সেটার জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানী যারা রয়েছে তাদের আরো বেশি জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের তিনটি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। যার স্বাদ এবং ফলন কোনটাই শীতকালীন পেঁয়াজের চেয়ে কম না। এ মধ্যে বারি পেঁয়াজ-২ এবং ৩ বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে চাষ করার জন্য উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এসব পেঁয়াজের বীজ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের ভেতর জমিতে বুনতে হয়। এসব বীজ গজানোর পর এপ্রিল মাসে মাঠে চারা রোপণ করা হয়। গ্রীষ্মকালীন চারা মাঠে লাগানোর ৮০ থেকে ৯০ দিনের ভেতর পেঁয়াজ সংগ্রহ করার উপযোগী হয়ে যায়। ফলে জুলাই-আগস্ট মাসের ভেতর সংগ্রহ করে ফেলা সম্ভব। যা শীতকালীন পেঁয়াজ সংগ্রহ করার চার মাস আগেই পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বর্ষাকালেও চাষ করা যায়। এক্ষেত্রে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে চারা উৎপাদন করতে হয়। উঁচু জমি হলে ভাল হয়। যাতে জমিতে পানি জমতে না পারে। জুলাই থেকে আগস্ট মাসে চারা করে সেপ্টেম্বর মাসেই চারা মূল জমিতে লাগানো যায়। এতে করে অন্তত দুই মাস আগেই পেঁয়াজ সংগ্রহ করা যায়। বর্ষাকালে লাগালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ জাত গুলো ৫০ থেকে ৫৫ দিন পরেই সংগ্রহ করা যায়। এ ফলশ্রুতিতে দেশে শতভাগ পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব।

সব বিত্তের মানুষের রান্নাঘরেই পেঁয়াজ অত্যাবশ্যকীয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, সব বিত্তের মানুষের রান্নাঘরেই পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ। পেঁয়াজ নেই, এমন কোন রান্না ঘর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ কোন রান্না শুরু করার আগে, কড়াইতে তেল দেয়ার পরপরই সাধারণত: যে উপাদানটি ব্যবহার করা হয় সেটি পেঁয়াজ। একদিকে মধ্যবিত্ত বা ধনীর টেবিলে হরেক আমিষ পদ, সেখানেও যেমন পেঁয়াজ চাই, অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষ, তাঁরও কোথাও পান্তাভাতের সঙ্গে এক টুকরো পেঁয়াজ বা ডাল-আলু সেদ্ধ, পেঁয়াজ। এটুকু না পেলে খাওয়াই তো হবে না। সালাতে পেঁয়াজ, মুড়ি মাখায় পেঁয়াজ, ভতার্য় পেঁয়াজ, তেলেভাজার মুখ্য তালিকাতেও পেঁয়াজের পিঁয়াজি। মোদ্দা কথা, পেঁয়াজ ছাড়া আমাদের রসনার তৃপ্তি নেই। পেঁয়াজের স্বাস্থ্যগুণের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

পেঁয়াজ এমন একটি উদ্ভিদ- যা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় ভারত ও চীনে। যে সব দেশে প্রধানত পেঁয়াজ হয় যেখানে বেশি বৃষ্টি হয় না। পাশাপাশি হাল্কা শীত থাকে। সে জন্যই আমাদের দেশে পেঁয়াজ বেশি হয় শীতকালে। আমরা জানি, পেঁয়াজ পচনশীল। পেঁয়াজ সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ প্রয়োজন। এজন্য পেঁয়াজ সংরক্ষণের দিকে মনোযোগী হতে হবে, যাতে সারা বছরই পেঁয়াজের সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায়। এছাড়া আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। মজুদ ব্যবস্থা জোরদার করাসহ স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। তারও আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে পেঁয়াজ সিন্ডিকেট। লক্ষ করা যায়, কোনো পণ্যের দাম বিদেশের বাজারে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেরাই বাড়িয়ে দেন। এভাবে ক্রেতা ঠকানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে এবং দায়ীদের যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিদেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশের বাজারে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা লাভের চেষ্টা করছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। এ বিষয়ে কারো অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।

আমরা দেখেছি, মৌসুমে কৃষকরা পেঁয়াজের দাম পান না। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ চাষিদের একটি নির্ভরযোগ্য স্থিতিশীল বাজারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে এবং আমাদেরো একটু দাম দিয়ে পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে যাতে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হলেও যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেঁয়াজ ফলায়, তারা ক্ষতির সম্মুখীন হন। পেঁয়াজ দুষ্প্রাপ্য হলে কিংবা দাম বাড়লে বেশিরভাগ সময়ে পেঁয়াজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। চিন, তুর্কি কিংবা মিসর থেকে আমদানি করার প্রক্রিয়া শুরু হলে ভারত আবার পেঁয়াজের দাম কমিয়ে দিতে পারে কারণ ২০১৭ সালে ভারত এমনই করেছিল। তুর্কি, চিন বা মিসর থেকে যারা আমদানি করে তখন তারা পথে বসে। পেঁয়াজ নিয়ে এই সিন্ডিকেটবাজি চলছেই। রাজা যায় রাজা আসে সিন্ডিকেটের তাতে কিছু যায় আসে না। পেঁয়াজ নিজে জ্বলে এবং অন্যকে তুমুল জ্বালায়।

দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী প্রধান এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, বগুড়া ও লালমনিরহাট। এসব এলাকায় কৃষকদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে বেশি উৎসাহ দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার ৯ টি পন্যের প্রণোদনা দেওয়া ঘোষনা দিয়েছে। এ মধ্যে পেঁয়াজও রয়েছে। এ পেঁয়াজে প্রণোদনা কৃষক যাতে সরাসরি পায় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সর্বপরি, সঠিক নিয়ম অনুযায়ী গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করা গেলে ভারতের উপর নির্ভরশীলতা শূণ্য শতাংশ নেমে আসবে। সে সাথে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনেরও স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করবো।

লেখকঃ জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *