কৃষকের অধিকার আমাদের দেশের অধিকার

কৃষকের অধিকার


বশিরুল ইসলাম 
কৃষকের অধিকার ঃ ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বানকিনায় গ্রামের আবদুল মালেক সিকদার পাকা ধানেই পেট্রোল ঢেলে আগুন দিলেন ক্ষুব্ধ কৃষক। কৃষি প্রধান দেশে এটা কি ভাবা যায়? আমি একজন কৃষিবিদ হিসেবে মনে করি,  কৃষক শুধু তার জমিতে আগুন দেয়নি। দিয়েছে, পুরো জাতিকে, ভদ্র সমাজকে। যারা কথায় কথায় কৃষি আর কৃষকের কথা বলে, অথচ রোদে পুড়ে – বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারে না  তাদের শরীরে। আসলে, আমাদের চামড়াতো গন্ডার চামড়া,  নাও লাগতে পারে!!!   সরকারি হিসাবে এক মণ বোরো ধানের দাম ১ হাজার ৪০ টাকা।  কিন্তু কোনো জায়গাতেই সরকার নির্ধারিত মূল্যে সংগ্রহ হচ্ছে না ধান। এলাকাভেদে মণপ্রতি ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে বোরো ধান বাজারে বিক্রি হচ্ছে, যা ধানকাটার শ্রমিকের দৈনিক মজুরির প্রায় অর্ধেক। কারণ ৯শ থেকে এক হাজার টাকা রোজের নিচে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তদুপরি তাদের তিন বেলা খাবারও দিতে হচ্ছে। বাজারদর কম হওয়ায় এটি কৃষকের ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


আমাদের প্রশ্ন হলো, লোকসান দিয়ে কৃষক কেন ধান উৎপাদন করবে? এসব সমস্যা ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টিও মাথা রাখতে হয় কৃষককে। হাওরাঞ্চলে বাঁধ ভেঙে কৃষি ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড়ে ধানসহ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব আশঙ্কা মাথায় নিয়েই কৃষক ফসল উৎপাদন করে। এই উৎপাদন খরচই যদি বিক্রয় মূল্যের চেয়ে বেশি হয় তাহলে কৃষক কেন ধান উৎপাদন করবে? বিগত কয়েক বছর  ধরে আমন ও বোরোর বাম্পার ফলন হলেও ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। এ বছরও ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে যেন হাসি নেই। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে ধানের দাম অনেক কম হওয়ায় আনন্দের পরিবর্তে তাদের চোখে-মুখে যেন কান্নার ছাপ। একদিকে বাজারে ধানের দাম কম অন্যদিকে কাটা-মাড়াইয়ে শ্রমিকের চরম সঙ্কট। অনেক জেলায় বেশি মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাচ্ছে না কৃষকরা।

  
শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনা, নীতিমালা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। আমার বিশ্বাস, এ বছর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে তাতে দেশের চাহিদা পূরণ করে চাল রপ্তানি করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, ধানের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিক সাফল্য দেশের জিডিপি ও খাদ্য নিরাপত্তায় বড় অবদান রাখছে। কিন্তু যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করছে তারাই হচ্ছে সর্বস্বান্ত। শুধু যে ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হয় তাই নয়। পাট, সরিষা, ভূট্টা, আলু শাক-সবজি কোনও ফসলেরই ন্যায্যমূল্য পায় না কৃষকরা। একশ্রেণির ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী নানা কৌশলে কৃষকদের সারাবছরই ঠকায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা চাষাবাদে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় সরকারিভাবে ধান-চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে তা থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করে। এমনটা শুধু এবারই নয়। যুগ যুগ ধরেই বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকসমাজ। অথচ কৃষকদের উৎপন্ন ফসল ব্যবসায়ী ব্যবসা করে বড় লোক, গাড়ি-বাড়ির মালিক অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু গরিব কৃষকদের ঠকিয়ে বা বঞ্চিত করে কেন? এটা সবার মনে রাখা উচিত যে, কৃষক বাঁচলে কৃষি বাঁচবে। কৃষি বাঁচলে বাঁচবে আমাদের দেশও। কৃষক যদি না বাঁচে, কৃষি যদি মার খায় বারবার, তাহলে দেশের উন্নয়ন মাঠে মারা যাবে। কৃষকের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। কৃষির উন্নয়ন মানে জাতির উন্নয়ন। এ সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায়, ততই আমাদের মঙ্গল।  


আমাদের মৌলিক চাহিদার প্রথম হচ্ছে খাদ্য। আর দেশের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে কৃষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার প্রশ্ন হলো, এ কৃষকরা কতটুকু সুবিধা পায় আমাদের দেশে ? সুবিধা পাওয়ার দরকার নেই, ন্যায্য অধিকারটুকুই তো পায় না তারা। কৃষকরা হাজার-লক্ষ টাকা সুদ-ঘুষ দাবি করে না।এ তাদের দাবি খুবই অল্প, একটু ভালো বীজ, বিনামূল্যে সার-কীটনাশক আর একটা ভালোত দাম। কিন্তু এর কোনোটাই কৃষকরা ঠিকভাবে পায় না। যেগুলো পায় সেগুলো চড়া দামে কিনতে হয়। যদিও আমাদের দেশের সব সরকারই কৃষকদের ভর্তুকি বা বিনামূল্যে সার-কীটনাশক দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, সরকার ও কৃষকের মধ্যবর্তী যে গ্রুপটা থাকে তাদের কারণে কৃষকরা তাদের সুবিধাগুলো পায় না। আর ঠিক এই একই সমস্যা কৃষকরা বীজ-সার-কীটনাশকের ক্ষেত্রেও ভোগ করে। 

কৃষকের অধিকার : আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা দরকার তা হলো ক্রপ ইনস্যুরেন্স। গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে যদি গাড়ি পাওয়া যায়,  তাহলে বন্যা কিংবা যেকোনো দুযোগে ফসল নষ্ট হলে তার ভর্তুকিও কৃষক পেতে পারে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারকে ধান ক্রয়কেন্দ্র খুলতে হবে। যাতে কৃষক সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারে। তা ছাড়া , ধান উৎপাদনের জন্য সার-ওষুধসহ যেসব উপকরণ দরকার হয় সেসব উপকরণের মূল্য কমাতে হবে। যদি উৎপাদন খরচ আরও কমানো যায় এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারে তাহলে কৃষকের লোকসান হবে না। কিছু লাভ হবে। যদি ধান উৎপাদন করে কৃষকের কিছু টাকা লাভ হয় তাহলে তারা ধান উৎপাদন করতে উৎসাহ বোধ করবে। তাদের মুখে হাসি ফুটবে।  এ ফলে হাসবে সারাদেশ। হাসির ভাগ যদি নিতে হয় তাহলে কান্নার ভাগও নিতে হবে। আর সকল কিছুর ভার শুধু সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না। এই দায়িত্ব সকলের। একবার ভাবুন তো, কৃষক যদি ফসল চাষ না করে তাহলে আমরা খাব কি? আমাদের দেশ চলবে কি করে?  তাই কৃষকের অধিকার আমাদের দেশের অধিকার। 

Advisory Editor

Advisory Editor of http://www.krishisongbad.com/

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *