জাতীয় কৃষি দিবসের ভাবনা :কৃষকের অধিকার নিশ্চিত হোক

জাতীয় কৃষি দিবসের ভাবনা

জাতীয় কৃষি দিবসের ভাবনা
মোঃ বশিরুল ইসলাম

জাতীয় কৃষি দিবসের ভাবনা ঃবাংলাদেশ ধানের দেশ-গানের দেশ-পাখির দেশ- তাই অগ্রহায়ণে ধান কাটার উৎসব গ্রামবাংলা তথা বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য। আবহমান এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পহেলা অগ্রহায়ণ দিনটি পালন করে আসছে এ দেশের জনগন নবান্ন উৎসব তথা জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে। হাজারো দিবসের মধ্যে একটি দিবস নির্ধারিত হয়েছে, যাতে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে।

আমাদের মনে আছে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রফতানির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন টালবাহানা শুরু করে তখন আমাদের জাতীয় নেতাদের বোধোদয় হয়। তারা বুঝতে পারে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকার পহেলা অগ্রহায়ণ জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হয়। তারপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাগ্রহণের পর ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় পহেলা অগ্রহায়ণ পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস।

কৃষি থেকে প্রাপ্ত অনুষঙ্গই আমাদের জীবন বাঁচানোর সরাসরি নিয়ামক। খাদ্য ও পুষ্টি আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর একমাত্র উপাদান, এসবের জোগানও আসে কৃষি থেকে। আমাদের চাহিদার তথা প্রয়োজনের বড় প্রাপ্তি যেহেতু কৃষি থেকে আসে তাই বিরাট ভরসার স্থল এবং বেঁচে থাকার ও উন্নয়নের নির্ঘণ্টক মৌলিক ক্ষেত্রও কৃষি। কৃষি উৎপাদন ভালো হলে জাতীয় অর্থনীতি হয়ে ওঠে সবল ও সমৃদ্ধ। কিন্তু কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশে আসে অভাব ও দুর্যোগ। হাহাকার দেখার যায় চারদিকে। তাইতো কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কৃষক সংগঠন রয়েছে। এ সংগঠন কৃষককে কেন্দ্র করে গঠন করা হলেও রাজনীতির মূলধারার থেকে প্রান্তে ঠেলে দেয়া হয় কৃষি ও কৃষকের স্বার্থকে। বরং দলীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকে এ সংগঠনগুলো। ৮০ দশকে ক্ষেতমজুর আন্দোলনের পর কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এভাবে অধিকারহীন কৃষকরা আজ অসংগঠিত, অসহায় ও ভাষাহীন। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্ব জুড়ে কৃষি ও কৃষকের এই করুণ অবস্থা। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে আমরা দেখেছি, গ্রামের জমিদার ও পুরোহিতদের অত্যাচারে গরিব চাষি গফুর মেয়ে আমিনার হাত ধরে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছিলে। ভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার পর কৃষকের এই যে করুণ অবস্থা, তা থেকে এদেশ আজো মুক্ত হয়নি।

আমাদের দেশের কৃষকরা ঘামঝরা পরিশ্রম করে ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দিয়ে চলছেন। কিন্তু তাদের ঘামঝরা পরিশ্রম থেকে যতটুকু উৎপাদন ও আয় হওয়া উচিত, তা তারা পাচ্ছে না। কৃষকের ফসলের লাভের অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। যেহেতু প্রতি বছরই কৃষি দিবস পালন করা হচ্ছে, সেহেতু গ্রামে গ্রামে কৃষি সমবায় সমিতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এতে করে কৃষি দিবস উদযাপনে রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কৃষক জানতে পারবে সরকারি ভর্তুকি তারা কী পরিমাণ পাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসের দায়িত্ব কী, সরকার থেকে উন্নতমানের বীজ ও সার কীভাবে-কখন পাওয়া যাবে। তারা সরাসরি সরকারের কাছে অভিযোগ করতে পারবে কখন-কীভাবে কৃষি উৎপাদনে হয়রানির স্বীকার হচ্ছে।

কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষক, প্রান্তিক কৃষক, বর্গাচাষি চিহ্নিত করে তাদের রেজিস্ট্রেশন করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা বছরের এ দিনটিতে কৃষকের অভিযোগ শুনে পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়নে ব্যবস্থা করতে হবে। সে সাথে কৃষক যাতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় –তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি কাজে কৃষক যাতে আরও উৎসাহ পায় তার জন্য প্রতি বছর কৃষি দিবসে কৃষকের জন্য চমকপ্রদ ঘোষণা থাকতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলার সেরা কৃষককে পুরস্কারে ব্যবস্থা করতে পারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ ব্যবস্থাগুলো বাস্তবরূপ দিতে পারলে কৃষি দিবস উদযাপন সফল হবে। অন্যথায় কৃষি দিবস যদি শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে আমদানি আর সাহায্যনির্ভর জাতি হিসেবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের দেশের সরকার থেকে শুরু করে জনগণ পর্যন্ত সবাই কৃষির সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ১০ টাকায় কৃষক হিসাব উম্মুক্তকরণ, কৃষিতে ভর্তুকি, বাড়তি সেচ সুবিধা, রেকর্ড পরিমাণ কৃষি ঋণ বিতরণ, সম্প্রসারিত কৃষি গবেষণা, কৃষি কার্ড বিতরণ, কৃষক ডাটাবেজ তৈরী, কৃষি জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ, কৃষি উপকরণ আমদানীতে সহায়তা প্রদান কৃষির ব্যাপারে সরকারি সদিচ্ছার প্রকষ্ট উদাহরণ। আমি নিজেও একজন কৃষক পরিবারের ছেলে। ফসল ফলাতে গিয়ে একজন কৃষকের কী রকম শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন হয় তা আমার জানা। এ দেশের কৃষকরা হরতাল করতে পারে না, তারা দুর্বল কণ্ঠ নিয়ে তাদের ন্যায্য মূল্য ও ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও জানে না। কৃষির ওপর নির্ভরশীল এ দেশে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে এ খেলা আর কত দিন চলবে- এ প্রশ্ন এ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছেই রইল।

মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষায় কবি নজরুল লাঙ্গল-এর মাধ্যমে সমস্যাজর্জরিত কৃষকের সপক্ষে যে দাবিগুলো পেশ করলেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। কৃষক যাতে তার উৎপন্ন ফসল থেকে উপযুক্ত মুনাফা পান, জমিতে তার কায়েমি স্বত্ব বজায় থাকে এবং জমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করা না যায়Ñ এ জন্য দাবিগুলো আজকের দিনেও শুধু কৃষক নয়, গোটা জাতির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় কৃষি দিবসের স্বীকৃতি দিয়ে বাংলার মাটিতে প্রত্যাবর্তন পহেলা অঘ্রাণের মানে আমাদের আদি নববর্ষের। পুনারায় নববর্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হলেও নবান্ন পালন কিন্তু অসম্ভব কিছু না। বছরে দুটো বাঙালির উৎসব জাতীয় পরিসরে হলে ক্ষতি কি? চারুকলা যদি মঙ্গলশোভা যাত্রার উদ্যোগ নিতে পারে তাহলে দেশের এতগুলো কৃষি প্রতিষ্ঠান কি পারে না একত্রিত হয়ে এটা আয়োজন করতে ? তাছাড়া ঢাকার ভিতরে অবস্থিত শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয় এবং কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে বড় পরিসরে আয়োজন করতে পারে। এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে কৃষি মন্ত্রনালয়। তাছাড়া, চারুকলা আর ছায়ানটকেও সঙ্গে নেওয়া যায়, তাদের ছাড়া তো বাঙালি উৎসব পূর্নাঙ্গতা পায় না। তাই, সরকারে কাছে আমার আকুল আবেদন পহেলা বৈশাখে মত জাতীয় কৃষি দিবস সারাদেশে উৎসবমুখ পরিবেশে পালন করা হোক।

জাতীয় কৃষি দিবস বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক আর কৃষকের অধিকার নিশ্চিত হোক এ প্রত্যাশা রইল।

লেখকঃ জনসংযোগ কর্মকর্তা (দায়িত্বপ্রাপ্ত)
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *