জেনে নিন ফলের রাজা আম চাষের টুকিটাকি নানা জরুরি বিষয়

আম চাষের টুকিটাকি

মো.শাহীন সরদার

আম চাষের টুকিটাকি
আম বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ফল। স্বাদ,গন্ধ, পুষ্টিমান ও ব্যবহার বৈচিত্র্যের ভিন্নতায় আমকে ‘ফলের রাজা’ বলে অভিহিত করা হয়। আমের ব্যবহার কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় কদরনীয়। এজন্য বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই আমের চাষ হয় ও বর্তমানেও হচ্ছে ব্যাপক হারে। জলবায়ু ও উৎকৃষ্ট মানের বিচারে যদিও আম উৎপাদন প্রধানত উত্তর পশ্চিমের জেলা গুলোতে হয়ে থাকে; যেমন- চাঁপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ও চুয়াডাঙ্গাঁ। বাংলাদেশে উৎপাদিত আমগুলোকে পাকার সময় অনুযায়ী আগাম, মৌসুমী ও নাবী জাত হিসাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। তাই আমের বাগান বা আম উৎপাদনের ক্ষেতে অবশ্যই নিম্মলিখিত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

আম চাষে করনীয়
জলবায়ু
জলবায়ুর উপাদান গুলোর মধ্যে তাপমাত্রা আম চাষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তাপমাত্রা ২৪-২৭ ডিগ্রি সেন্টিেিগ্রড । খুব ঠান্ডা (১০ ডিগ্রি সেন্টিেিগ্রড তাপমাত্রার নিচে) বা খুব গরম (৪০ ডিগ্রি সেন্টিেিগ্রড তাপমাত্রার উপরে) তাপমাত্রায় জন্মানো গাছে বিভিন্ন ধরণের শারীর তাত্ত্বিক অস্বাভাবিকতা যেমন- পাতা ঝলসানো, বীজের ভ্রন নষ্ট হওয়া, ফল মরা ইত্যাদি দেখা যায়। পুস্পায়ন ও ফল ধারণ উভয় সময়ে আকাশ কুয়াশামুক্ত, তুষারমুক্ত, ও মেঘমুক্ত থাকা উচিত। অতিরিক্ত বায়ুমন্ডলীয় আর্দ্রতায় পোকা মাকড় ও রোগের উপদ্রব বেশি হয়। আমের জন্য বৃষ্টিপাত কম হওয়া ভালো (সর্বনিম্ন ২৫ সে.মি. ও সর্বোচ্চ ২৫০ সে.মি.)।
বাৎসরিক মোট বৃষ্টিপাত ২৫০ সে.মি. এর বেশি হলে তেমন কোন ক্ষতি নেই, যদি বারমাসেই সুষমভাবে বৃষ্টিপাত হয়। তবে পুষ্পায়ন ও ফল ধারণের সময় বৃষ্টিহীন হতে হবে। ফুল ধারণের সময় বৃষ্টি হলে পরাগরেণু ধুরে যায়। এতে ফল ধারণ কম হয়। আবার বায়ুর প্রবাহ বেশি হলে ফল ঝরে যেতে সাহায্য করে। অন্যদিকে বায়ুর গতিবেগ বেশি হলে মাটি হতে পানি দ্রুত বাষ্পীভুত হয়ে যায়, ফলে মাটিতে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যাওয়ায় গাছের বৃদ্ধি ব্যহৃত হয়।

মাটি ও রোপন
উর্বর পলিমাটি আম চাষের বিশেষ উপযোগী। ৫.৬-৭.৫ পিএইচ সম্পন্ন মাটিতে আম ভালো জন্মে। পিএইচ ৭.৫- এর বেশি হলে সে মাটিতে আম ভালো হয় না। আমগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা। জলাবদ্ধ মাটিতে গাছের বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণ ব্যহত হয়। তাই জলাবদ্ধ ও বন্যা কবলিত জায়গায় আম চাষ করা উচিত নয়। জমি ভাল ভাবে চাষ করে শ্রাবণী-১ ও শ্রাবণী-২ আমের জন্য ৫ মি. X ৫ মি. দূরে দূরে ৭৫-১০০ সে.মি. × ৭৫-১০০ সে. মি. X ৭৫-১০০ সে. মি. আকারে গর্ত করতে হয়। কলমের চারা রোপন করার ২৫/৩০ দিন পূর্বে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পঁচা গোবর, ১৫০ গ্রাম টি.এস.পি, ১৫০ গ্রাম পটাশ এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ৫০ গ্রাম করে বোরাক্স, জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট, ২ কেজি ছাই ও ১০০-২০০ গ্রাম পঁচা খৈল প্রয়োগ করে গর্তের মাটির সাথে ভালভাবে মিশায়ে রেখে দিতে হবে। এরপর গাছ লাগানো যাবে। পট/পলিব্যাগে চারা থাকলে সারা বছর গাছ লাগানো যায়। জানুয়ারী-ফেব্র“য়ারী মাসে ফুল আসে এবং জুন-জুলাই মাসে ফল পরিপক্ক হয়। সুনিস্কাশিত উর্বর দোঁআশ মাটি উত্তম। ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ক হতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সময় লাগে। প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। ৪-৫ মিটার দূরে দূরে প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪৬০ টি চারা রোপন করা যায়। রোপনকাল থেকে ফল পেতে এক বছর সময় লাগে।

সার প্রয়োগ
কলমের চারা লাগানোর পর গাছের বয়স ভেদে সার প্রয়োগ করতে হবে। একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে (৪-৫ বছর) ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর সার, ৫০০ – ৬০০ গ্রাম করে পটাশ ও টি.এস.পি সার এবং ৪০০-৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ২০০-২৫০ গ্রাম পচা খৈল, ২-৫ কেজি ছাই ও ৫০-১০০ গ্রাম করে বোরাক্স, জিপসাম ও জিঙ্ক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। গাছে সার প্রয়োগের সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, দুপুর বেলায় গাছ যে জায়গাটুকু জুড়ে ছায়া প্রদান করে সে পরিমান জায়গা গাছের গোড়া থেকে ৫০ সে.মি. দূরে সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভাল ভাবে সার মাটির সাথে মিশিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে উলট-পালট করে দিতে হবে। এর পর সেচ প্রদান করতে হবে। জুন-জুলাই মাসে ১ বছরের একটি গাছে ৩-৪ টি এবং ২ বয়সের একটি গাছে ৫-১০ টি সিলভারমিক্স ফোর্ট/সিলভার ম্যাক্স জৈব সার গাছের গোড়া থেকে ৫০-৭৫ সে. মি. দূরে মাটির ৫-৭ সে. মি. গভীরে পূঁতে দিতে হবে। ৪-৫ বছরের একটি গাছে ১০-২০টি ট্যাবলেট জাতীয় জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর সেচ দেওয়া ভালো। এই গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই বর্ষাকালে পানি নিকাশ ও খরা মৌসুমে সেচ প্রদান করা দরকার।

ছাঁটাই
ফল সংগ্রহের পর পরই (জুন-আগস্ট) হাল্কা ভাবে ছেঁটে দেয়া হয়। সাধারণত অন্যান্য ফল গাছের মত আমের ক্ষেত্রে ট্রেনিং খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ প্রাকৃতিকভাবে এটি ডোম আকৃতির হয়ে থাকে। রোপনের পর প্রায় চার বৎসর পর্যন্ত ছাঁটাই ছাড়াই গাছকে বাড়তে দেয়া উচিৎ। তারপর গাছের কেন্দ্রস্থিত কিছু ডাল-পালা পাতলা করে দেয়া উচিত। পুরনো বয়স্ক গাছে ডাল-পালার ছাঁটাই করা প্রয়োজন যাতে করে বেশি পরিমাণ আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে এবং পোকা-মাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গাছে ফল ধরা অবস্থাতে কোন কোন ক্ষেত্রে গাছের পরিধির দিকে যেসব ডালপালা থাকে তাদের চাইতে কেন্দ্রের দিকে অবস্থিত ডালপালা কেটে ফেলা উচিত। এতে করে প্রচুর সূর্যালোক এবং আলো-বাতাস চলাচল করবে এবং বেশি সায়ন পাওয়া যাবে। অবাঞ্চিত জল শোষক , খর্ব এবং দূর্বল শাখাসমূহ যেগুলো প্রধান শাখার নীচে ছায়াতে জন্মায় সেগুলো কেটে ফেলতে হবে। অনেক সময় অল্প কিছু ছোট ডাল-পালা কর্তকতার সাথে ছাঁটাই করে একাšতরক্রমিক ফল ধারণ প্রবণতা কমানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোদাল দিয়ে মূল ছাঁটাই করলে তা একাšতক্রমিক ফল ধারণ রোধ করতে সহায়ক হয়। যে সকল আম গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ভাল কিন্তু অনিয়মিত ফলধারী, তাদের ক্ষেত্রেও ছাঁটাই করা প্রয়োজন। রোগাক্রান্ত, কীটাক্রন্ত, মরা, আধমরা ডাল ছাড়া অন্য কোন ডাল কখনই ছাঁটাই করা উচিত নয়। ৩০-৫০ বছর বয়স্ক গাছ বেশী করে ছাঁটাই করলে ভাল সায়ন দেয়।
টবে/অর্ধড্রামে আম চাষ
মাটির তৈরী টব অথবা অর্ধ ড্রামে আম এর চাষ সফল ভাবে করা যেতে পারে। এজন্য সমপরিমান মাটি ও পচা গোবর সার (অর্ধেক মাটি + অর্ধেক পচা গোবর সার) ভালোভাবে মিশিয়ে টবে/ অর্ধড্রামে নিয়ে চারা কলম লাগাতে হবে। এ জন্য কোন রাসায়নিক সার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে গাছের নতুন কচি পাতা বের হয়ে তা পরিপক্ক হওয়ার পর ২-৩টি ট্যাবলেট জাতীয় জৈব সার (সিলভার ম্যাক্স/সিলভামিক্স ফোর্ট) গাছের গোড়া থেকে ৫-৭ সে.মি. দূরে মাটির ৫-৭ সে.মি. গভীরে পুঁতে দিতে হবে। তবে টবে/অর্ধ ড্রামকৃত গাছে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা রাখার জন্য নিয়মিত সেচ ও নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

অন্যান্য পরিচর্যাঃ
গাছের গোড়ায় সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা দরকার। গাছ লাগানোর সাথে সাথে খুঁটি দিয়ে (৪) চার এর মত ‘নট’ করে বেঁধে দিতে হবে। কলমের জোড়ার নিচের অংশের কুঁশি বের হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঁঙ্গে বা কেটে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে জৈব-অজৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের ভিতর মরা এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে।
পোকা-মাকড় ও রোগ বালাইঃ
শ্রাবণী আমে পোকা-মাকড় খুবই কম। তবে বিছা পোকা ও গাছের কচি পাতার ক্ষেত্রে পাতা কাটা ও পাতা খেকো পোকার উপদ্রব দেখা যায়। পোকা দমনের জন্য সাইপার মেথ্রিন গ্র“পের যে কোন কীটনাশক (ডেসিস/সিমবুশ/সুমিথিয়ন/ম্যালাথিয়ন) ২ মি.লি. প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়।

রোগের মধ্যে পাউডারী মিলিডিউ, পাতায় মরিচাপড়া রোগ, এ্যানথ্রাকনোজ, পাতা পোড়া রোগ ও ম্যালফরমেশন দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কপার ফাংগিসাইড/ছত্রাকনাশক বোর্দোমিশ্রন (তুঁতঃচুনঃপানি=১:১:১০) / (থিওভিট/ব্যাভিষ্টিন/ডায়থেন এম-৪৫/রিদোমিল) ২ মি.গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে সহজেই এ রোগ দমন করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *