ঘরের সৌন্দর্যে বনসাই একটি অনন্য উপকরণঃ তৈরি করুন নিজেই

ঘরের সৌন্দর্যে বনসাই

বকুল হাসান খান, আবদুল কাদের

প্রথম পর্ব

বনসাই ’ শব্দটি জাপানি। ‘ বন’ মানে ছোট পাত্র, ‘ সাই’ মানে বসানো। এক অর্থে ছোট পাত্রে গাছ বসানো। বনসাই এর আক্ষরিক অর্থ ছোট হলেও বুৎপত্তিগত অর্থ ব্যাপক। বহুদিনের প্রচেষ্টায় কোন গাছের স্বাভাবিকত্ব বজায় রেখে আকারে ছোট রাখার পদ্ধতিকে বনসাই প্রথা বলা হয়। ছোট গাছ ছোট পাত্রে বসানো হলেই তাকে বনসাই বলা যাবে না। গাছে বয়সের ছাপ ও আকারে ছোট গাছকে বনসাই বলা যাবে। গাছের আকার প্রকারের সঙ্গে সামজস্য রেখে পাত্রের আকার প্রতার স্থির করতে হবে। এইভাবে গাছ রাখার রীতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বামনাকুতি গাছ তৈরী করে ছোট পাত্রে বসিয়ে নিজের কাছে রাখতে বহু ব্যক্তিকেই দেখা গেছে। বর্তমানেও এ ধরনের গাছ করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। দেশ – বিদেশে অনেক বনসাই করা গাছ আছে যা একাধারে শিল্প সৌন্দর্য গুনে সমৃদ্ধ ও বিস্মিত হতে হয় শিল্পীর বামন গাছ তৈরীর কর্ম নৈপুন্যে। বনসাই তৈরীর প্রথা বিশ্বে প্রথম উৎপত্তি হয় চীন দেশে।

বনসাই এর উৎপত্তি ঃ পাত্রে ছোট গাছ বসানোকে চীনা ভাষায় বলা হয় ‘ পান সাই’। বর্তমান জাপানি প্রথার সঙ্গে কিছুটা প্রকারভেদও ছিল। চীনারা অপেক্ষাকৃত বড় পাত্রে একক গাছ না বসিয়ে একাধিক গাছ ও মধ্যে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, ঝরণা তৈরী করতো। এক কথায় খন্ডিত প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারনা। জাপানিদের অধিকাংশ কাজই একক পাত্রে একক গাছ। একটি পাত্রে একাধিক গাছ ( কমিউনিটি প্ল্যানটেশন ) খুব কমই দেখা যায়। অবশ্য বনসাই পদ্ধতিতে গাছ করার শ্রীবৃদ্ধি জাপানিদের দ্বারাই হয়েছে। এই কাজে জাপানিদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। বন্য গাছের সৌন্দর্য ও ভাল লাগা বামন গাছ তৈরী করার কারণ বলা যেতে পারে। বহু ব্যক্তির বহুদিনের প্রচেষ্টায় তৈরী গাছগুলি সুন্দর শিল্পকীর্তির পর্যায়ে পড়ে। বামন গাছ করার শিল্পকলার দিক অবহেলা করে যেমন- তেমন ভাবে যাল বাঁকানো বা কাটা বনসাই করার সঠিক পদ্ধতি নয়। বনসাই করা গাছের প্রকৃত রূপ হবে একই জাতীয় কোনও বড় গাছের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি, শুধু আকারে ছোট।

এই পদ্ধতিতে গাছ করাকে জীবন্ত শিল্পকলা (লিভিং আর্ট) বলা হয়ে থাকে। কারণ শিল্পকলার প্রয়োগ হয় একটি জীবন্ত গাছের উপড়। গান,বাজনা, নাচ ও আঁকা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। এই কাজে যতদিন গাছটি বাঁচবে ততদিন পর্যন্ত সমানভাবে তার পরিচর্যা করে যেতে হবে। ভাল-মন্দ বিচারে বয়সের বিষয়টির যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা এছ। গাছ নির্বাচনের কাজটিও সুচিন্তিত ভাবে করতে হবে। এজন্য এমন গাছ নির্বাচন করা প্রয়োজন যা অধিক বৎসর বেঁচে থাকে, সহজেই কান্ডের নীচের দিকে স্ফীত হয়ে গুড়ির আকার ধারণ করে এবং মধ্যম বয়সেই কান্ডে গায়ে রুক্ষতার ছাপ পড়ে। এ ছাড়া মূল শেকর কাটা, ডাল বাঁকানোর কষ্ট সহ্য করতে পারে। দু’তিন বৎসর অন্তর মাটি বদলানো ও ছোট পাত্রে অল্প মাটিতে বসানোর পর মরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম ও পাতা ছোট হয়ে আসে।

বনসাই উপযোগী গাছ ঃ উপরে উল্লিখিত গুনগুলির অধিকারী কয়েক জাতীয় গাছের নাম উদাহরণ স্বরুপ উল্লেখ করা হলো- (১) বট ( ফাইকাস বেঙ্গলিয়েনসিস), অশ্বত্থ (ফাইকাস রিলিজিওসা) , বকুল, শিমুল, ঝাউ, ক্রিয়েন্টা, বোগেনভিলা, ব্রাসিয়া, অ্যাকটিনি ফোলিয়া, ফাইকাস বেঞ্জামিনা প্রভৃতি। প্রতিকুল অবস্থার কারণেও অনেক সময় প্রকৃতি সৃষ্ট ভাল বনসাই গঠনের গাছ পাওয়া যায়। সযতেœ এই ধরণের গাছ সংগ্রহ করেও বনসাই গাছের সংগ্রহ বৃৃদ্ধি করা যায়। বনসাই প্রেমিকেরা ভাল গাছ পাওয়ার আশায় বনে-জঙ্গলে ও নানা দিকে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যায়। অবশ্য এই প্রচেষ্টায় খুব কম লোকেই প্রকৃত বনসাই রূপের গাছ পেয়ে থাকেন।

উৎপাদন পদ্ধতি ঃ‘ বনসাই ’ বীজ ও কলম উভয় প্রকার গাছের দ্বারাই করা যাবে। বীজ থেকে হওয়া গাছগুলো হলো অশ্বত্থ, পাকুড়, তেঁতুল, শিমুল, বাবলা, শিরীষ ইত্যাদি। কলমের গাছে ভাল হবে ফলের গাছ, ঝাউ, ক্রিসেন্টা, ক্রিউজেটা ও কয়েক রকমের ফাইকাস।

এই কাজ শুরু করতে হবে দু – এক বছর বয়সের গাছ দিয়ে, কারণ ছোট গাছের কান্ড, ডাল নরম থাকার জন্য তারের সাহায্যে নানাভাবে ডালের বিন্যাস ও কান্ডের পরিবর্তন করে সুন্দর রূপ প্রদান করা যায়। ডাল বেশী শক্ত হয়ে গেলে প্রয়োজন মতো আকৃতি তৈরী করা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে থাকে। অনেক সময় ডাল ভেঙ্গে গিয়ে বিরূপাকৃতি হয়ে ওঠে। অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সের গাছের মূল শিকড় কাটার বিপদের ঝুঁকি বেশী। অল্প বয়সী গাছের কোন ডাল ভেঙ্গে গেলে পুনরায় তা গজানোর সম্ভাবনা থাকে ; যা বয়স হওযা গাছের ক্ষেত্রে আশা করা যায় না। সাধারণভাবে বনসাই করা গাছ ছোট পাত্রে বসানো হয়। প্রথম থেকে গাছকে ছোট পাত্রে বসানো হলে যে অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয় তা হচ্ছে- ছোট জায়গার অল্প খাবার খেয়ে গাছের বৃদ্ধি অনেক কম হয় ও কান্ড শেকড় মোটা হতে দেরী হয়। বৃদ্ধির অভাবে ডালের সংখ্যা কম হওয়ার ফলে ডালের বিন্যাস ঘটিয়ে গাছটিকে তৈরী করতে সময় অনেক বেশী লাগে। বনসাই পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা কোন গাছকে একই জাতীয় গাছের প্রতিকৃতি তৈরী করার জন্য করণীয় কাজগুলি যথাক্রমে মূল, শেকড় (ট্যাপরুট) কাটা, যথেচ্ছ ভাবে থাকা ডালগুলি যথাযথ বিন্যাস ও কান্ডের সরল সোজা গঠনের পরিবর্তন করে বয়স্ক চেহারার ছাপ নতুন গাছের উপর ফুটিয়ে তোলা, মূল শেকড় কাটার পূর্বে দেখে নিতে হবে গাছের সতেজতা। কমজোরী গাছের বৃদ্ধি এমনিতেই কম, শেকড় কাটা হলে তা আরও কমে যাবে। এই সব অসুবিধার কথা চিন্তা করে বনসাই শুরুর প্রথম দিকে ছোট পাত্রে গাছ না বসিয়ে অপেক্ষাকৃত বড় পাত্রে বসানো উচিত। বড় গাছের কান্ড বনসাই পদ্ধতি প্রয়োগের সাহায্যে স্ফীত ও ইচ্ছানুযায়ী আকৃতিতে গঠন করা সুবিধাজনক। ডালের সংখ্যা বেশী হয়। অপ্রয়োজনীয় ডাল কেটে বাকিগুলিকে ভাল ভাবে সাজিয়ে নিতে হবে। দু’ এক দিনের অযতেœ বড় পাত্রের গাছের মরে যাবার ভয় থাকে না। উপরোক্ত কারণে প্রথম দু’ বছর গাছকে বড় পাত্রে রাখা ভাল।

 চলবে—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *